বৃহস্পতিবার রাশিয়া যে দ্যনিপ্রো শহরে আক্রমণের জন্য দ্রুতগামী ও শক্তিশালী নতুন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেন্সকি তার নিন্দে জানিয়ে এটিকে “পারমাণবিক অভিযান” বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন এটি এই যুদ্ধকে মারাত্মকভাবে তীব্রতর করে তুলেছে।
এই আক্রমণ যুদ্ধে নতুন বিপজ্জনক পর্যায়ের আশংকা সৃষ্টি করেছে। পরে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ওই আক্রমণে মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের কথা স্বীকার করেন।
জেলেন্সকি এই আক্রমণকে মস্কোর আরও সম্প্রসারিত কৌশলের ইঙ্গিত বলে উল্লেখ করে বলেন, “এটা পরিস্কার যে পুতিন বিশ্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ এই সব অস্ত্র ব্যবহারের পরীক্ষা ক্ষেত্র হিসেবে ইউক্রেনকে ব্যবহার করছেন”।
অসামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর রাশিয়ার এই আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন নিয়ে তাঁর এই মন্তব্য কিয়েভে ক্রমবর্ধমান আশংকাকে বাড়িয়ে তুলেছে।
ওদিকে পুতিন তাঁর ভাষণে মাঝারি পাল্লার পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন ওরেশনিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহারকে এই সংঘাতের সময়ে নিয়মিত পরীক্ষা বলে উল্লেখ করেন।
যদিও তিনি কিছু প্রযুক্তিগত বিষয়ে বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেন, বিশ্লেষকরা বলছেন ক্ষেপণাস্ত্রটির ব্যবহার এবং পুতিনের স্বীকারোক্তিতে মনে হচ্ছে নেটো ও যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা প্রদর্শনের ইচ্ছাকেই তা তুলে ধরেছে।
পুতিনের এই ঘোষণায় রাশিয়া যুদ্ধের সময়ে এই ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের কথা এই প্রথমবারের মতো খোলাখুলি ভাবে স্বীকার করলো।
ওয়াশিংটনে পেন্টাগনের ডেপুটি প্রেস সচিব সাবরিনা সিং বলেন যে ক্ষেপণাস্ত্রটি ব্যবহার করা হয় সেটি রাশিয়ার আরএস২৬ অব্যবহৃত আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মডেলে তৈরি। তিনি বলেন নিউক্লিয়ার রিস্ক রিডাকশান চ্যানেলের মাধ্যমে এটি নিক্ষেপের আগে সংক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়।
কৌশলগত মাত্রা
যুক্তরাষ্ট্রে ইউক্রেনের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ভ্যালেরি চ্যালি এই আক্রমণকে রাশিয়ার আগ্রাসনের একটি “নতুন পর্যায়”বর্ণনা করেছেন। ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে কথা বলার সময়ে তিনি জোর দিয়েই বলেন যে এটি কেবলমাত্র ইউক্রেনের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ ছিল না, তার পশ্চিমি মিত্রদের প্রতিও একটি চ্যালেঞ্জ ।
চ্যালি বলেন, “এটি শুধুমাত্র ইউক্রেনের ব্যাপার নয়, এটি ইউরোপীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চ্যালেঞ্জ। পশ্চিমকে প্রভাবিত করার জন্য মস্কো এটিকে নাটকীয় ভাবে তীব্র করতে তাদের প্রস্তুতির ব্যাপারে আভাস দিচ্ছে”।
তিনি বলেন এই আক্রমণের বিরুদ্ধে জবাব “হতে হবে স্পষ্ট, একতাবদ্ধ এবং চূড়ান্ত- এর চেয়ে কম হলে রাশিয়াকে আরও সাহসী করে তুলবে এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে”।
পশ্চিমি নেতারা এই আক্রমণের দ্রুত নিন্দা জানান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেইর স্টারমার এটিকে “বেপরোয়া ও বিপজ্জনক” বলে অভিহিত করেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক মুখপাত্র পিটার স্ট্যানো এটিকে রাশিয়ার কৌশলের “ গুণগত বৃদ্ধি” বলে বর্ণনা করেন।
দ্যনিপ্রোতে আক্রমণ
ক্ষেপণাস্ত্রটি দ্যনিপ্রোর শিল্প স্থাপনাগুলিকে লক্ষ্য বস্তু করে, এতে দুই জন আহত হন এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতি হয়। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা প্রথমে আইসিবিএম আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের কথা বলেছিলেন । তবে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত বিশ্লেষকরাসহ কোন কোন বিশ্লেষক বলছেন যে এটি খুব সম্ভবত মধ্যম বা মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রই ছিল,যেমনটি পুতিনও বলেছিলেন।
তবে এই আক্রমণের গতি ও শক্তিতে অনেকেই কেঁপে ওঠেন।
দ্য ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ারের রাশিয়া টিমের একজন বিশেষজ্ঞ জর্জ ব্যারোস ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “ইউক্রেনের অধিবাসীদের উচিৎ হবে না, এই আক্রমণকে নিয়ে অতিরিক্ত কোন প্রতিক্রিয়া দেখানো”।
সোভিয়েত আমলের মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রসঙ্গেই ব্যারোস বলেন, “ মনে হচ্ছে রুশরা আর-২৬ আইআরবিএম দিয়েই শহরটি লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছিল। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে আতঙ্কিত না হওয়া। এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে অন্য কোন যুদ্ধের তূলনায় পুতিন সম্ভবত আর কোন পারমানবিক অস্ত্র কিংবা গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করবেন”।
তিনি আরও বলেন, “ এটাইতো প্রথমবার নয় যে রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে পারমাণবিক ভাবে সক্ষম অস্ত্র ব্যবহার করেছে। রাশিয়া নিয়মিত ভাবেই পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন ইস্কান্দার অস্ত্রগুলি ব্যবহার করে থাকে এবং মনে হচ্ছে এ বার এটাই ইঙ্গিত দেবার চেষ্টা করা হয়েছে যাতে ইউক্রেনকে আর কোন পশ্চিমি সহায়তা দেওয়া না হয়।
কৌশলগত অস্পষ্টতা
পুতিন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার কথা নিশ্চিত করলেও, ক্রেমলিনের মুখপাত্র দ্যমিত্রি পেসকভ ও রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রী মারিয়া ঝাখারোভা এই আক্রমণ সম্পর্কে বিস্তারিত তেমন কিছু বলেননি। বলা হচ্ছে ঝাকারোভাকে বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলনের সময়ে এই আক্রমণ সম্পর্কে কিছু না বলার নির্দেশ দেওয়া হয়।
কোন কোন বিশ্লেষক বলছেন পরিকল্পিত ভাবে নীরবে থাকার এই বিষয়টি বৈশ্বিক অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলেছে যখন রাশিয়া স্পষ্ট ভাবে সতর্ক করে দিচ্ছে আবার প্রচ্ছন্ন ভাবে হুমকিও দিচ্ছে। তারা বলছেন এই অস্পষ্টতা আসলে আরও বড় রকমের কৌশলেরই অংশ যাতে রাশিয়ার আগামি পদক্ষেপ সম্পর্কে পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখা যায়।