রক্তাক্ত ২১ জুলাই: আদালতের রায়, ছাত্রদ্রোহ ও প্রাণহানির দিন

৪ সপ্তাহ আগে
২১ জুলাই ২০২৪। বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় একটি দিন, যেদিন একটি রায়ের অপেক্ষায় গোটা জাতি তাকিয়ে ছিল আদালতের দিকে, আর রাজপথে ঝরেছিল আরও রক্ত। কোটা সংস্কার আন্দোলনের জেরে দেশজুড়ে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি বিরোধী দলের ওপর দমনপীড়ন, কারফিউ, ইন্টারনেট বন্ধ, আন্তর্জাতিক উদ্বেগ সব মিলিয়ে দিনটি হয়ে ওঠে ২০২৪ সালের সবচেয়ে সংঘাতপূর্ণ ও নৃশংস দিনগুলোর একটি।

সর্বোচ্চ আদালতের রায়

 

এই দিনেই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এক ঐতিহাসিক রায় দেন। সরকারি চাকরিতে নিয়োগে মাত্র ৭ শতাংশ কোটা রাখার নির্দেশ দিয়ে বাকি ৯৩ শতাংশ পদ মেধার ভিত্তিতে পূরণের নির্দেশ দেন আদালত। এর মাধ্যমে আদালত হাইকোর্টের পূর্বের একটি রায় বাতিল করেন, যেখানে কোটা পুনর্বহালের পক্ষে মত দেয়া হয়েছিল।

 

রায়ে বলা হয়, এই নির্দেশনা সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজনে কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারে। আদালতের এই পর্যবেক্ষণ একদিকে সরকারকে নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে রাখলেও, অন্যদিকে সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতেই রাখে। তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এ রায়কে সরকারের বিজয় হিসেবে তুলে ধরেন এবং শিগগিরই প্রজ্ঞাপন জারির কথা জানান।

 

দ্রোহ ও রক্তপাত

 

আদালতের এই রায়ের প্রেক্ষিতে সরকার দাবি করে, সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়েছে কিন্তু রাজপথের বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এদিন ঢাকাসহ অন্তত ছয় জেলায় প্রাণ হারান ১৯ জন। শুধু রাজধানীতেই নিহত হন ১০ জন। বাকিরা নিহত হন নরসিংদী (৪), গাজীপুর (২), নারায়ণগঞ্জ (১), সাভার (১), এবং চট্টগ্রামে (১)। পুলিশের গুলি ও সংঘর্ষে আহত হন শতাধিক মানুষ। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল বিশেষ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভর্তি হন, যেখানে পাঁচটি মৃতদেহ আনা হয়।

 

আরও পড়ুন: রক্তাক্ত ২০ জুলাই: রাস্তায় কাউকে দেখা মাত্রই গুলির নির্দেশনা দেয় সরকার

 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঢাকার চিটাগাং রোড, সাইনবোর্ড, সানারপাড়, ধানিয়া ও বসুন্ধরার প্রগতি সরণি এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। পাশাপাশি মিরপুর-১০ এলাকায় ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানির চারটি বাস ভাঙচুর করে বিক্ষোভকারীরা। আন্দোলনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয় ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ রাজপথগুলো।

 

ইন্টারনেট বন্ধ ও কারফিউ জারি

 

২১ জুলাই ছিল দেশব্যাপী দ্বিতীয় দিনের কারফিউ। রাতের আগেই সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। মোবাইল ইন্টারনেট ছিল পুরোপুরি বন্ধ। তবু ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে সংবাদকর্মীদের কাছে পৌঁছায় ছাত্র আন্দোলনের বার্তা। ৫৬ জন ছাত্রনেতার স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে সরকারের বিরুদ্ধে তিন শতাধিক হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ওঠে। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, আদালতের রায় হলেও এই রক্তের দায় সরকার এড়াতে পারবে না।

 

আন্দোলনকারীদের ওপর নিপীড়ন

 

এই দিনেই আন্দোলনের শীর্ষ সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে অপহরণ করা হয়। পরে তাকে অচেতন অবস্থায় ঢাকার পূর্বাচল এলাকায় একটি ব্রিজের নিচে ফেলে যায় অপহরণকারীরা। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে নাহিদ জানান, সাদা পোশাকধারীরা চোখ বেঁধে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে নির্যাতন করে। জ্ঞান হারানো পর্যন্ত সেই নির্যাতন চলেছে।

 

আরও পড়ুন: জুলাই চেতনাকে সম্মান জানাতেই দ্রুত ডাকসু নির্বাচন: ঢাবি উপাচার্য

 

এই ঘটনায় আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ায়। বিকেলে আন্দোলনের তিনজন সমন্বয়ক (নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ) ৪৮ ঘণ্টার জন্য শাটডাউন স্থগিতের ঘোষণা দেন। তারা চারটি দাবি তুলে ধরেন: কারফিউ প্রত্যাহার, ইন্টারনেট চালু, হল খুলে দেয়া এবং আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু অন্যান্য সমন্বয়করা এই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ৯ দফা দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন।

 

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

 

রাজপথে চলমান হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতায় আন্তর্জাতিক মহলও উদ্বেগ প্রকাশ করে। জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভল্কার তুর্ক এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা গভীর উদ্বেগজনক।’ তিনি নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানান। যুক্তরাষ্ট্র তাদের নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করে এবং দূতাবাসের অপ্রয়োজনীয় কর্মীদের দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়।

 

সরকার একদিকে আন্দোলনকারীদের জামায়াত-বিএনপি ও শিবির সংশ্লিষ্ট ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দেয়, অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের ‘ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা’ বলে অভিযোগ তোলে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সরকার রাষ্ট্রীয় মিডিয়াকে ব্যবহার করে বিরোধীদের ওপর দোষ চাপাচ্ছে।’ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের আদালতের রায়কে ‘সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন’ বলেও মন্তব্য করেন।

 

আরও পড়ুন: গণ-অভ্যুত্থান: ১৯ জুলাই হেলিকপ্টার থেকে চলে গুলিবর্ষণ

 

বিভক্ত সরকার ও জনগণ

 

২১ জুলাই ছিল বিভাজনের একটি দিন। একদিকে সরকারের দাবি, আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়েছে; অন্যদিকে রাজপথে শোকে মুহ্যমান পরিবার, ক্ষুব্ধ জনতা ও রক্তাক্ত ছাত্র সমাজ। আদালতের রায় প্রশাসনিকভাবে একটি মাইলফলক হলেও বাস্তবে আন্দোলনের দাবিগুলো কতটা পূরণ হলো, সে নিয়ে তখন থেকেই প্রশ্ন উঠে।

 

এই দিন প্রমাণ করে দেয় রাষ্ট্রযন্ত্র, রাজনীতি ও জনগণের মধ্যকার আস্থা কতটা ভঙ্গুর হতে পারে। আদালতের রায়, রাজপথের আন্দোলন আর রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়ার এই নাটকীয় সমন্বয় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বাস্তবতায় এক নতুন মাত্রা যোগ করে।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন