যেভাবে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছাল হামাস-ইসরাইল

১ সপ্তাহে আগে
গাজায় ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি রোববার (১৯ জানুয়ারি) সকাল থেকে কার্যকর হয়েছে। এর ফলে ১৫ মাসের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের পর ছিটমহলটির ২০ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনির সীমাহীন দুর্ভোগ কিছুটা হলেও লাঘব হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

চুক্তি অনুযায়ী হামাসের হাতে থাকা ৩৩ ইসরাইলি জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে ইসরাইল তাদের হাতে আটক শতাধিক ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে। চুক্তির প্রথম ধাপে ছয় সপ্তাহের মধ্যে এই বন্দি বিনিময় হবে।

 

একই সঙ্গে গাজার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার করা হবে এবং বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা তাদের বাড়িঘরে ফেরার অনুমতি পাবে। পাশাপাশি ত্রাণবাহী ট্রাকগুলোকে প্রতিদিন গাজায় প্রবেশ করতে দেয়া হবে।

 

দ্বিতীয় ধাপে হামাসের হাতে থাকা বাকি জিম্মিরা মুক্তি পাবে এবং গাজা থেকে ইসরাইলি সেনা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হবে। এর মাধ্যমে 'টেকসই শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে'।

 

তৃতীয় ও চূড়ান্ত ধাপে গাজা পুনর্গঠন হবে- যা শেষ করতে কয়েক বছর পর্যন্ত লাগতে পারে। একই সঙ্গে মৃত ইসরাইলি জিম্মিদের মরদেহ ফেরত দেয়া হবে।

 

চুক্তি অনুযায়ী, প্রথম ধাপে রোববার তিন ইসরাইলি জিম্মিকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। এদিকে গাজার লাখ লাখ উদ্বাস্তু ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। ঢুকতে শুরু করেছে সীমান্তে অপেক্ষমান ত্রাণবাহী ট্রাকগুলো।

 

এটা গাজায় কার্যকর হওয়া দ্বিতীয় কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি, যার পথ ছিল দীর্ঘ ও কঠিন। যেভাবে এই চুক্তি কার্যকর হল তা এক ঝলকে দেখে নেয়া যাক।

 

প্রথম যুদ্ধবিরতি

 

বছরের পর বছর ধরে নজিরবিহীন নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ, ভূমির জবরদখল ও আল আকসা মসজিদে অপতৎপরতার জবাবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে আকস্মিক আক্রমণ চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের যোদ্ধারা। ওই হামলায় এক হাজার ২০০ জনের বেশি নিহত হয়। জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয় ২৫০ জনের বেশি মানুষকে।

 

হামাসের হামলার অজুহাতে ইসরাইলি সেনাবাহিনী গাজায় সর্বাত্মক বিমান ও স্থল হামলা শুরু করে। করতে থাকে অবিরাম বোমাবর্ষণ। যার ফলে মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে ১৪ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। সেই সঙ্গে আনুমানিক ১৭ লাখ ফিলিস্তিনি ঘরবাড়ি ছেড়ে গাজার দক্ষিণাঞ্চলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।


আরও পড়ুন: টানা ৯৬ ঘণ্টার আলোচনায় চূড়ান্ত হয় গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি

 

এদিকে যুদ্ধ থামাতে শুরু হয় কূটনৈতিক তৎপরতা। কাতারের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলমান আলোচনা এবং একাধিকবার চুক্তি ভেঙে যাওয়ার পর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার মন্ত্রিসভার একটি বৈঠক ডাকেন, যেখানে ভোটাভুটির মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুমোদন করা হয়।

 

২০২৩ সালের ২৪ নভেম্বর সাতদিনের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। চুক্তির অংশ হিসাবে ১১০ জন বন্দিকে মুক্তি দেয় হামাস। বিপরীতে ইসরাইল ২৪০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেয়, যাদের সকলেই নারী ও শিশু। 

 

যুদ্ধবিরতির সময়ই নেতানিয়াহু স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে, ইসরাইল গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ করছে না এবং যুদ্ধবিরতি কেবল অস্থায়ী। ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর ইসরাইল আবারও হামলা শুরু করে।

 

আন্তর্জাতিক চাপ

 

গাজায় ইসরাইলের অসম যুদ্ধ তীব্রতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ এবং অবস্থান কর্মসূচি পালন করে যা বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

 

গাজায় ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞের মধ্যে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। আয়ারল্যান্ড, স্পেন ও নরওয়েসহ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানায়।

 

দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটি গণহত্যা মামলা দায়ের করে যে মামলায় পরবর্তীতে বেলজিয়াম, কলম্বিয়া, তুরস্ক, মিশর, চিলি ও স্পেনসহ কমপক্ষে ১৪টি দেশ সমর্থন জানায়।

 

অব্যাহত আলোচনা 

 

২০২৪ সালের মে মাসে গাজার যুদ্ধ যখন অষ্টম মাসে প্রবেশ করে। এ সময় আলোচনা আরও এগিয়ে যায়। এতে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর আশা আরও জোরদার হয়। কায়রোতে মিশরীয় ও কাতারি কর্মকর্তারা একটি চুক্তির জন্য মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। এরপর হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া ৬ মে জানান যে, তার দল একটি প্রস্তাব পেয়েছে। ফিলিস্তিনিরা গাজার রাস্তায় উদযাপন শুরু করে।

 

ওই চুক্তি তিন ধাপে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল। চুক্তিতে বলা হয়েছিল যে, ৪২ দিনের মধ্যে ইসরাইলি কারাগারে শত শত ফিলিস্তিনি বন্দির বিনিময়ে হামাস ৩৩ জন ইসরাইলি বন্দিকে মুক্তি দেবে। দ্বিতীয় ধাপে, ইসরাইলি সেনাবাহিনী গাজা থেকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করবে।

 

তবে ইসরাইল জানায় যে, তারা যুদ্ধবিরতির শর্তাবলিতে সম্মত হয়নি। এর পরপরই ইসরাইল দক্ষিণ গাজার রাফায় হামলা শুরু করে। তারপর মে মাসের শেষের দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব দেন এবং জানান, ইসরাইল 'স্থায়ী যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে' সম্মত হয়েছে। কিন্তু নেতানিয়াহু পরিকল্পনাটি প্রত্যাখ্যান করেন এবং যুদ্ধ চালিয়ে যান।

 

লেবানন যুদ্ধ

 

গাজায় সামরিক আগ্রাসন শুরুর পরদিনই অর্থাৎ ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর ইসরাইল ও হিজবুল্লাহ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠীটি জানায়, তারা গাজার সঙ্গে সংহতি প্রকাশের অংশ হিসেবে ইসরাইলের ওপর গুলি চালাচ্ছে। গাজা যুদ্ধের মধ্যেই চলতে থাকে ইসরাইল ও হিজবুল্লাহ লড়াই।

 

এরপর ২০২৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ইসরাইল লেবাননে তীব্র আক্রমণ শুরু করে। হামলায় একদিনে লেবাননের ৫৫০ জনেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। এর কয়েকদিন পর হিজবুল্লাহর দীর্ঘদিনের নেতা হাসান নাসরুল্লাহসহ গোষ্ঠীটির বেশ কয়েকজন নেতাকে হত্যা করা হয়। 

 

কয়েকদিন পর ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর ইসরাইলি বাহিনী দক্ষিণ লেবাননে স্থল অভিযান শুরু করে। এতে লেবাননের অন্তত ৩ হাজার ৮০০ নিরীহ মানুষের প্রাণ যায়। আহত হন প্রায় ১৬ হাজার। বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়, ১২ লাখ। লড়াইয়ে এক লাখের কাছাকাছি বাড়িঘর ও অন্যান্য স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয় ইসরাইলি বাহিনী।


আরও পড়ুন: গাজায় ঢুকতে শুরু করেছে ত্রাণবাহী ট্রাক

 

প্রায় দুই মাস পর গত ২৭ নভেম্বর একটি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী, হিজবুল্লাহ লিটানি নদীর উত্তরে তার সামরিক অবকাঠামো প্রত্যাহার করবে এবং লেবাননের সশস্ত্র বাহিনী দক্ষিণ লেবাননে মোতায়েন করবে। যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে আরও বলা হয় যে, ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার আগেই ইসরাইলি সেনাদের দক্ষিণ লেবানন থেকে প্রত্যাহার করতে হবে।

 

তবে ইসরাইলি সেনারা যুদ্ধবিরতি চুক্তি মানছে না। সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে এখনও তাদের উপস্থিতি রয়েছে এবং বাড়িঘর ও গ্রাম ধ্বংস করছে। আগামী ২৬ জানুয়ারি চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। এই সময়সীমার দুই সপ্তাহ আগে লেবাননে হিজবুল্লাহর লক্ষ্যবস্তুতে হামলা শুরু করেছে ইসরাইল।

 

দৃশ্যপটে ট্রাম্পের আবির্ভাব

 

গত ২ ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়ায় এক পোস্টে জানান যে, তিনি ক্ষমতায় আসার আগে গাজার বন্দিদের মুক্তি না দিলে ‘চরম মূল্য দিতে হবে’। এরপর তিনি ডিসেম্বরের শেষের দিকে এবং জানুয়ারির শুরুতে আবারও যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান।

 

অবশেষে যুদ্ধবিরতি চুক্তি

 

যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের কয়েক মাসের মধ্যস্থতায় টানা ১৫ মাসের সংঘাতের পর বুধবার (১৫ জানুয়ারি) গাজায় দ্বিতীয় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে একমত হয় ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস। পাঁচদিন পর স্থানীয় সময় রোববার (১৯ জানুয়ারি) বেলা সোয়া ১১টায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।  

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন