ময়মনসিংহে প্রকৃতি সাজিয়ে রেখেছে নিজেকে, অথচ নেই উন্নয়ন

১ সপ্তাহে আগে
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শন, পাহাড়, নদী আর সংস্কৃতির এক অপার সম্ভারে ভরপুর বাংলাদেশের ময়মনসিংহ বিভাগ। তবে অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পর্যটন শিল্পটি এখানকার চারটি জেলাতে আজও রয়েছে উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত। পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূল সমস্যা হলো সরকারের সদিচ্ছার অভাব ও পরিকল্পনার ঘাটতি। যদি যোগাযোগ, নিরাপত্তা ও আবাসনসহ কিছু মৌলিক উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ছুটে আসবেন এই অঞ্চল ঘিরে।

শেরপুর: গারো পাহাড়ের সৌন্দর্য, পরিকাঠামোর দুর্বলতা


গারো পাহাড় আর আদিবাসী অধ্যুষিত জনপদ শেরপুর। ইকো-ট্যুরিজম গড়ে ওঠার বিরাট সুযোগ থাকলেও অবকাঠামোগত দুর্বলতায় সেই সম্ভাবনা রয়ে গেছে অপূর্ণ।
ঝিনাইগাতীর গজনী অবকাশ কেন্দ্রের সৌন্দর্য দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে হাজারো পর্যটক আসলেও, দীর্ঘদিনেও এখানে নির্মাণ হয়নি আবাসিক হোটেল-মোটেল। নেই টুরিস্ট পুলিশও। এতে দিন দিন পর্যটক শূন্য হয়ে পড়ছে সম্ভাবনাময় এই পর্যটন কেন্দ্রটি।


পর্যটকরা বলেন, এখানে আসলে নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। থাকার কোনো ব্যবস্থা নাই। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও নাজুক, ছিনতাই আতঙ্কে থাকতে হয়। শুধু তাই না, মোবাইলে নেটওয়ার্ক না থাকায়, পরিবারের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হয়। এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে।


এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, আমাদের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী আছে। এর বাইরে পুলিশ কাজ করছে, যাতে এখানে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে। আমাদের এখানে অনেক রাইডের ব্যবস্থা রয়েছে। আগে থেকেই অনেক রাইড নির্মাণ করা হয়েছে। তবুও আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি আরও নতুন নতুর রাইড তৈরি করার জন্য। বাচ্চারা এখানে এসে অনেক ইনজয় করবে আশা করি।


আরও পড়ুন: যদি ভালোবাসেন পাহাড় আর স্থাপত্য, ঘুরে আসুন শেরপুর


তিনি আরও বলেন, পর্যটকরা এখানে এসে যেন রাত্রীযাপন করতে পারেন, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছি আমরা। আমরা আশা করছি, অচিরেই এই পর্যটন কেন্দ্রগুলো দূর-দূরান্ত থেকে আসার মানুষের প্রিয় একটি বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে সমাদ্রিত হবে।


নেত্রকোনা: চোখ জুড়ানো পাহাড়-নদী, নেই যোগাযোগের সুবিধা


প্রকৃতির সব সৌন্দর্য যেন ধরা দেয় নেত্রকোনার কলমাকান্দার লেঙ্গুরা গ্রামে। নদী আর পাহাড়ের সৌন্দর্য, চোখ জুড়ানো দুর্গাপুরের সাদামাটির পাহাড় মুগ্ধ করে প্রকৃতিপ্রেমীকে। কিন্তু, যোগাযোগ ব্যবস্থা নাজুক হওয়ায় বিমুখ হচ্ছেন পর্যটকরা।


লেঙ্গুরা গ্রাম, দুর্গাপুরের সাদা মাটির পাহাড়, এমন সব নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও নেই রাস্তা, নেই পর্যটন অবকাঠামো।


আরও পড়ুন: ঘুরে আসুন জল-পাহাড়-আকাশের মিলনমেলা ‘মাধবপুর লেক’ থেকে


স্থানীয়রা জানান, জেলার দুর্গাপুরে ও কলমাকান্দা উপজেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। নয়নাভিরাম দৃশ্য মানুষকে আকৃষ্ট করে। ঘুরতে আসেন বিভিন্ন এলাকার ভ্রমণপিপাসুরা। কিন্তু এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দুই পাহাড়ি উপজেলার কোন উন্নয়নই হচ্ছে না। বিশেষ করে সৌন্দর্য উপভোগ করতে যাতায়াত সুবিধা না থাকায় এ সকল এলাকায় ভ্রমণপিপাসু এবং পর্যটকরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। প্রশাসন থেকে নানা উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও এখানে নেই বাস্তবায়ন।


জামালপুর: একমাত্র লাউচাপড়া কেন্দ্রও অবহেলায়


জামালপুরে পর্যটন বলতে একমাত্র লাউচাপড়া পিকনিক স্পটের কথাই আসে। ভারতীয় সীমান্তবর্তী এই এলাকাটি প্রাকৃতিকভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ হলেও পর্যাপ্ত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় এটি একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যটন কেন্দ্রে রূপ নেয়নি।


ভ্রমণপিপাসুরা বলেন, জামালপুরের একমাত্র পর্যটন কেন্দ্র লাউচাপড়াকে আরও আধুনিক দেখতে চাই। আরও বেশি দৃষ্টিনন্দন দেখতে চাই। চাইলেই লাউচাপড়ার পাহাড়ি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করা যায়। পর্যটক আকর্ষণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এখানে বিনিয়োগ প্রয়োজন।


আরও পড়ুন: ঘুরে আসুন দেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রামে


জামালপুর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সরকার আব্দুল্লাহ আল মামুন বাবু বলেন, জামালপুরের পর্যটন বলতে আমরা একমাত্র লাউচাপড়া পিকনিক স্পটকে বুঝি। এটা জেলা পরিষদের মালিকনাধীন। অত্যন্ত সুন্দর জায়গা, আমি মনে করি এই এলাকায় আশেপাশে অন্যান্য যত পর্যটন কেন্দ্র আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ সুন্দর লাউচাপড়া পিকনিক স্পট। তবে এটার উন্নয়ন যেটা পর্যটকবান্ধব যেটা হওয়ার উচিত ছিল সেটা সেভাবে উন্নত করা হয়নি।


তিনি আরও বলেন, আমরা ২৩-২৪ অর্থ বছরে ৬৪ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছি। কিছু রাস্তা করে দিয়েছি। এ বছর বরাদ্দ আসলে বাকি উন্নয়ন করবো।


ময়মনসিংহ: ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সমাহার, বিকাশে স্থবিরতা


ইতিহাস আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মেলবন্দন ময়মনসিংহ জেলায়। পর্যটনশিল্পে অপার সম্ভাবনা থাকার পরও এখানে নেই যথাযথ পর্যটনবান্ধব পরিবেশ।
ময়মনসিংহ নগরীতে শশী লজ, লোহার কুটির, গৌরীপুর লজ, আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলের মতো বিখ্যাত সব প্রাচীন স্থাপনা রয়েছে। উপজেলাগুলোর মধ্যে মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ি, গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর জমিদারবাড়ি, সখিনা বিবির সমাধিস্থল, হালুয়াঘাটে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাহাড়ি এলাকাসহ বিভিন্ন পর্যটনসমৃদ্ধ স্থান রয়েছে। এ ছাড়াও ভালুকার কাদিগড় জাতীয় উদ্যান, ফুলবাড়িয়ার রাবার বাগান ও বড়বিলা বিল, ধোবাউড়া উপজেলার চীনামাটির পাহাড় আর গারোপল্লি জেলার উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান।


পর্যটনশিল্পের এত সম্পদ অপার সম্ভাবনা থাকার পরও স্থবির হয়ে আছে এখানকার পর্যটনব্যবস্থা। ২০২০ সালে জেলার একমাত্র পর্যটনকেন্দ্র হালুয়াঘাটের গাবরাখালি গারো পাহাড় পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা হলেও নানা সংকটে হচ্ছে না বিকাশ। পড়ে আছে অনেকটা অযত্নে।


ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম বলেন, গাবরাখালি গারো পাহাড় পর্যটন কেন্দ্রকে আরও সুন্দর করতে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কাছে বরাদ্দ চেয়েছি। বরাদ্দ পেয়ে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিবো। সেই সাথে জেলার পর্যটনকে বিকশিত করতেও আমরা চেষ্টা করছি।


আরও পড়ুন: ঐতিহ্য ও প্রকৃতির রঙিন ভুবনে হারাতে একদিনে ঘুরে আসুন ময়মনসিংহ


শেরপুর থেকে ময়মনসিংহ, চার জেলায় পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন সরকারের স্বদিচ্ছা ও সঠিক পরিকল্পনা, বলছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব ময়মনসিংহের সদস্য সচিব মমিনুর রহমান প্লাবন বলেন, আমরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে গিয়ে যেসব সুযোগ-সুবিধা দেখি, যে তৃপ্তি নিয়ে ফিরে আসি, সেই বিষয়গুলো ময়মনসিংহ বিভাগে অনুপস্থিত। নদী-পাহাড়, ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সবই আমাদের আছে কিন্তু শুধুমাত্র প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা।


তিনি আরও বলেন, শুধু সভা-সেমিনার আর র‍্যালির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে যাতায়াত, আবাসনসহ যে সংকটগুলো রয়েছে সেগুলোর দিকে প্রশাসন নজর দিলে ময়মনসিংহ বিভাগও পর্যটন শিল্পে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। এতে স্থানীয় মানুষের জীবনমানে ইতিবাচক পরিবর্তনের পাশাপাশি সমৃদ্ধ হবে পুরো দেশের পর্যটনখাতও।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন