ভারতে গিয়ে অনেকে পড়ছেন মানব পাচারকারীদের জালে, হারাচ্ছেন স্বজন, কেউবা বছরের পর বছর কাটাচ্ছেন বিদেশি কারাগারে। খুলনার লবণচরার জয়নাল আবেদীনের জীবনে ঘটেছে এমনই মর্মান্তিক এক ঘটনা।
৩০ বছর বয়সী জয়নাল আবেদীন এক সময় দিনমজুরির পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি এক প্রতিবেশীর প্রলোভনে পড়ে স্ত্রী ও দুই কন্যাসন্তানকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ি জমান ভারতে। ভালো চিকিৎসা ও আয় রোজগারের আশায়। কিন্তু সেই যাত্রাতেই হারিয়ে ফেলেন নিজের সবকিছু।
খুলনার লবণচরা দশগেট এলাকার ভূমিপল্লীতে থাকতেন জয়নাল। মাথা আঘাতের কারণে অসুস্থ ছিলেন। প্রতিবেশী মনিরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী আছিরন বেগমের প্রলোভনে ২০২২ সালে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা আর ভালো কাজের স্বপ্ন দেখেন। তবে সেখানে গিয়েই বিপাকে পড়েন।
আরও পড়ুন: খুলনায় আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস উদযাপিত
চিকিৎসা তো দূরের কথা সারাদিন ময়লা থেকে ভাঙারি মালামাল সংগ্রহ করে যা উপার্জন করেন তার একটি অংশ কেটে নেন দালাল ও গোডাউন মালিক। এরই মধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অন্য দিকে তার ছোট মেয়ের হাত ভেঙে যায় আরেক প্রতিবেশীর ধাক্কায়। নানা ঘটনার পর দেড় বছরের মাথায় দেশ ফেরার জন্য দালালের কাছে টাকা পাঠান তার মা। ফেরার পথে ভারতের মহারাষ্ট্রের তুমকুড় রেলওয়ে স্টেশন থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হারিয়ে ফেলেন।
সেখানেই ট্রেন দুর্ঘটনায় তিনিও এক পা হারান। চিকিৎসার পর স্ত্রী-সন্তানকে খুঁজতে ফিরে যান চেন্নাই। বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে জয়নালের মা ও ছোট ভাই জানতে পারেন তার স্ত্রী সন্তান ভারতের একটি প্রদেশে আছেন। দেশে ফেরাতে সরকারি আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর ৮০ হাজার টাকায় বন্ধক ও রিকশা বিক্রি করে দালালের মাধ্যমে দেড় লাখ টাকা পাঠান। তবে ভাগ্য সহায় না হওয়ায় সীমান্ত পারি দেওয়ার সময় বিএসএফ’র হাতে আটক হয়ে ভারতে দমদম জেলে আছেন। ওদিকে পুনরায় দালালের মাধ্যমে টাকা দিয়ে জয়নালকে এ বছরের জানুয়ারিতে দেশে ফেরান তার মা। এ ঘটনায় লবনচরা থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন তিনি।
জয়নাল বলেন, ‘বউ-বাচ্চারে ট্রেনে হারাই, খুঁজতে গিয়ে দুর্ঘটনায় এক পা-ই কেটে ফেলতে হইছে। এখন তো চলাফেরাও করতে পারি না। ভারতে গিয়ে স্ত্রী-সন্তান ও এক পা সবই হারালাম। ওখানে গোডাউন মালিক ও দালালরা পাশবিক নির্যাতন করত। অমানবিক জীবনযাপন করতে হয় ওখানে। প্রায় এক বছর স্ত্রী-সন্তান ভারতের জেলে। তারা কেমন আছে জানি না। আমিও অসহায় হয়ে পড়েছি। মাথা গোঁজার ঘরটিও বন্ধক রেখে স্ত্রী-সন্তান ছাড়াতে টাকা পাঠিয়েছি। তবুও কোনো লাভ হয়নি। এখন আমি মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে স্ত্রী-সন্তান ফেরাতে সহযোগিতা চাচ্ছি। আর দালালরা আমাদের এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার হুমকি দিচ্ছে।’
জয়নালের ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। শুধু খুলনাই নয় যশোর, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহসহ সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে বহু মানুষ একই পরিণতির শিকার হয়েছেন। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে উঠেছে মানবপাচারের দালালচক্র। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষেরা তাদের প্রধান লক্ষ্য। প্রতারণার মাধ্যমে ভারতে পাঠিয়ে সেখানকার পাচারকারী চক্রের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে তাদের। কেউ হচ্ছেন নির্যাতিত, কেউ শ্রমে বাধ্য হচ্ছেন, আবার কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে কাটাচ্ছেন বছরের পর বছর কারাগারে।
গত একমাসে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে দেশে ফিরেছেন ভারতে সাজাভোগ করে আসা শিশুসহ ৪৫ জন বাংলাদেশি নাগরিক। তাদের অনেকেই পাচার বা অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে আটক হয়েছিলেন। জানা গেছে, অধিকাংশ ভুক্তভোগীর পাসপোর্ট ছিল না। ফলে ভারতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হন তারা। আবার অনেকে দীর্ঘদিন কারাগারে থেকে অবশেষে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সহায়তায় দেশে ফিরেছেন।
আরও পড়ুন: খুলনা নগরে পানির কষ্টে ৬ লাখ মানুষ
এ চক্র সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার-এর এরিয়া ম্যানেজার অপূর্ব সাহা বলেন, সচেতনতার অভাব ও প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে মানুষ নিজেরাই ডেকে আনছে সর্বনাশ। সমাজ ও প্রশাসনকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
অন্যদিকে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, যারা এই অপরাধে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ চলছে। মানবপাচার রোধে আমরা সচেষ্ট।
স্থানীয়দের অভিযোগ, অনেক সময় পাচারকারী বা দালালদের নাম জানা গেলেও তারা রয়ে যাচ্ছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক প্রভাব বা প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে বারবার পার পেয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে, ভারতে আটকে পড়া প্রিয়জনদের মুক্তির আশায় স্বজনরা দেশে জায়গা-জমি বিক্রি করছেন, কিংবা বন্ধক রেখে দালালদের কাছে দিচ্ছেন মোটা অঙ্কের টাকা। তবু ফিরছে না সেই মানুষ, ফিরছে শুধু দুঃখ, কান্না আর নিঃস্বতার দীর্ঘ ছায়া।
বিজিবি ২১ ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ খুরশীদ আনোয়ার বলেন, ‘সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পথে ভারতে প্রবেশ করতে গিয়ে অনেকেই বিপদে পড়ছেন। আমরা সীমান্ত রক্ষায় ও এ সকল কর্মকান্ড বন্ধে টহল জোরদার করেছি। প্রতি সপ্তাহে জনবসতি এলাকায় জনসচেতনতামূলক সভা করছি। মসজিদের মাইকে সচেতনমূলক ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। এখন প্রয়োজন মানব পাচারের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা।’