বিশ্ববাজারে তরতরিয়ে বাড়ছে স্বর্ণের দাম, ছুঁতে পারে ৫ হাজার ডলারের মাইলফলক!

৩ সপ্তাহ আগে
বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়ায় আবারও আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে স্বর্ণ। এবার দাম বাড়ছে হু হু করে, আর তাতেই বদলে যাচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনীতির চিত্র। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শুরু করে বড় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারী-সবাই অনিশ্চয়তার সময়টিতে সুরক্ষার শেষ ভরসা হিসেবে দেখছেন এই হলুদ ধাতুকে।

প্রাচীনকাল থেকেই প্রাচুর্যের অপর নাম স্বর্ণ। একে বলা হয়, অর্থের সবচেয়ে স্থায়ী রূপ। হাজার বছর ধরে মূল্যবান এই ধাতুর চোখ ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্য, দীপ্তি আর চাকচিক্য মানুষকে অভিভূত করে চলেছে। তাই প্রাচীনকাল থেকেই অন্যান্য ধাতুর চেয়ে স্বর্ণের দাম কয়েকগুণ বেশি।


স্বর্ণ দামি বা মূল্যবান; কারণ আমরা সমাজগতভাবে মনে করি, এর মূল্য অতীতে যেমন ছিল, আগামীতেও থাকবে। আর এই প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখে মানুষ স্বর্ণ রিজার্ভ করতে থাকে। যার প্রভাবও পড়ে স্বর্ণের বাজারে।
 

আরও পড়ুন: এবার ৩৬৫০ ডলারের মাইলফলক ছুঁলো স্বর্ণের দাম

 

 

ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয়- দুই পর্যায়েই স্বর্ণ জমিয়ে রাখার প্রবণতা দেখা যায়। কারণ এটি এমন এক বিনিয়োগ যাতে বড় ধরনের লোকসানের আশঙ্কা থাকে না। অর্থনীতির দুর্দিনে মানুষ স্বর্ণ কেনার দিকে ঝুঁকে পড়ে। অর্থের মূল্য ধরে রাখা যায় না, তবে স্বর্ণ কিনে রাখা লাভজনক কারণ এর মূল্য কমার চেয়ে বাড়ার প্রবণতাই বেশি।


২০২৪ সালে স্বর্ণের দাম ২৭ শতাংশ বেড়েছিল। বর্তমানেও বিশ্ববাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মূল্যবান এই ধাতুর দাম। চলতি বছর এখন পর্যন্ত দাম বেড়েছে ৩৮ শতাংশ। চলতি সপ্তাহে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ইতিহাসের রেকর্ড ছুঁয়ে ৩ হাজার ৬৫০ ডলার ছাড়িয়েছে।


কেন বাড়ছে স্বর্ণের দাম?


দাম বাড়ার পেছনে বড় কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার কমানোর সম্ভাবনা। সম্প্রতি দেশটির কর্মসংস্থান খাতের দুর্বল তথ্য প্রকাশ পাওয়ায় বাজারে জল্পনা বেড়েছে, ফেড চলতি বছরই তিন দফায় সুদ কমাতে পারে। প্রথম পদক্ষেপ আসতে পারে আগামী সপ্তাহের বৈঠকেই।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন ডলার দুর্বল হওয়া এবং বন্ড ইল্ড কমে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিমুক্ত সম্পদের দিকে ঝুঁকছেন। একই সঙ্গে, চলতি মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কমাবে-এমন প্রত্যাশা ও বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধারাবাহিক সঞ্চয়, আর্থিক খাতের অস্থিতিশীলতা এবং ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা- সব মিলিয়েই এই ধাতুর দামকে আরও শক্তিশালী করেছে।


কেসিএম ট্রেডের প্রধান বাজার বিশ্লেষক টিম ওয়াটারার বলেন, ‘মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি বাজারের প্রত্যাশা অনুযায়ী একাধিকবার সুদের হার কমায়, তাহলে স্বর্ণের দামে সামনে আরও ঊর্ধ্বগতি দেখা যেতে পারে।’


ক্যাপিটাল ডটকমের আর্থিক বাজার বিশ্লেষক কাইল রোডা বলেন, ‘দুর্বল অর্থনৈতিক পরিবেশ এবং মার্কিন সুদের হার কমানোর প্রত্যাশার প্রভাবেই মূল্যবান এই ধাতুর দাম বাড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত একটি বড় কারণ হল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফেডের স্বাধীনতার ওপর সমালোচনা, যা ডলারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে।’

 

স্বর্ণের রিজার্ভে পরিবর্তন


তবে শুধু সুদের হারের জল্পনা নয়, দাম বাড়ার মূলে রয়েছে বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তন। ইতিহাসে দ্রুততম হারে স্বর্ণ কিনছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো, যা ডলারের প্রতি আস্থাহীনতার স্পষ্ট ইঙ্গিত। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল জানায়, বর্তমানে বৈশ্বিক সরকারি রিজার্ভে ৩৬ হাজার ৭০০ টনেরও বেশি স্বর্ণ রয়েছে, যা মোট মজুতের ২৭ শতাংশ। শুধু ২০২৪ সালেই কেনা হয়েছে ১ হাজার ১৮০ টন-১৯৬৭ সালের পর যা সর্বোচ্চ।


সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ১৯৯৬ সালের পর প্রথমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর হাতে এখন মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের চেয়ে বেশি স্বর্ণ রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, তারা কেবল ঝুঁকি এড়ানোর চেষ্টা করছে না, বরং আর্থিক ব্যবস্থার নতুন বাস্তবতার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

 

আরও পড়ুন: স্বর্ণের রেকর্ড উত্থান: বিনিয়োগ বাড়লেও চাহিদা কমেছে স্বর্ণালঙ্কারের


এই প্রবণতা বিশেষভাবে স্পষ্ট উদীয়মান অর্থনীতিগুলোতে। চীন ইউয়ানকে শক্তিশালী করতে রিজার্ভ বাড়াচ্ছে, রাশিয়া পশ্চিমা আর্থিক বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বড় আকারে স্বর্ণ কিনছে। ভারত, তুরস্ক ও কাজাখস্তানের মতো দেশও মুদ্রার অস্থিরতা সামলাতে বাড়িয়েছে হোল্ডিং।


এমনকি উন্নত দেশগুলোও এ দৌড়ে পিছিয়ে নেই। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো একত্রে ধরে রেখেছে ১০ হাজার টনের বেশি স্বর্ণ, আর যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াও নতুন করে কৌশল বদলাচ্ছে।


সরবরাহে সীমাবদ্ধতা


কেবল চাহিদাই নয়, সরবরাহও সীমিত। খনি থেকে উৎপাদন বাড়ছে না, নতুন মজুতও মিলছে না তেমন। ফলে বাজারে ভৌত স্বর্ণের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, যা দাম আরও বাড়াচ্ছে।


এমন বাস্তবতায় বিনিয়োগকারীদের কাছে স্বর্ণের গুরুত্ব আরও স্পষ্ট। শেয়ারবাজারে অস্থিরতা, বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কা, বাড়তি ঋণ এবং রাজনৈতিক চাপ সব মিলিয়ে আস্থা কমছে ফিয়াট মুদ্রার প্রতি। ইতিহাসে নানা সংকটে স্বর্ণ যেভাবে মূল্য সংরক্ষণ করেছে, বর্তমানেও সেই বিশ্বাসই মানুষকে টানছে।


সামনে কী অপেক্ষা করছে?


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহুদিন ধরেই স্বর্ণ ‘নিরাপদ আশ্রয়’ হিসেবে পরিচিত, তবে সম্প্রতি এটিকে অনেকে ‘স্মার্ট ইনভেস্টমেন্ট’ হিসেবেও দেখছেন। খুব শিগগিরই দাম ৪ হাজার ডলার পেরিয়ে যেতে পারে। 


জ্যানার মেটালসের সিনিয়র কৌশলবিদ পিটার গ্রান্ট বলেন, ‘স্বর্ণের ঊর্ধ্বমুখিতা এখনও চলমান। স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে এর দাম ৩ হাজার ৮০০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে। আর আগামী বছরের প্রথম প্রান্তিকের শেষ নাগাদ স্বর্ণের দর ৪ হাজার ডলারের মাইলফলক ছুঁতে পারে।’


এখন প্রশ্নটা আর এই নয় যে স্বর্ণের দাম বাড়বে কিনা, বরং কত দ্রুত নতুন মাইলফলক ছোঁবে। আর ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত, ঋণ সংকট বা ডলারের বড় ধস এলে, দাম ৫ হাজার ডলারের দিকেও ছুটতে পারে।

 

প্রভাবশালী বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস স্বর্ণকে দীর্ঘমেয়াদি সবচেয়ে শক্তিশালী বিনিয়োগ বলছে। তাদের পূর্বাভাস বলছে, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ দাম ৩ হাজার ৭০০ ডলারে, আর ২০২৬ সালের মাঝামাঝি ৪ হাজার ডলারে পৌঁছাতে পারে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ড থেকে মাত্র এক শতাংশ বিনিয়োগ সরে এলে স্বর্ণের দাম ৫ হাজার ডলারের কাছাকাছি চলে যেতে পারে।


সম্প্রতি বিলিয়নিয়ার বিনিয়োগকারী জন পলসন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ২০২৮ সালের মধ্যে স্বর্ণের দাম প্রায় প্রতি আউন্স ৫ হাজার ডলারে পৌঁছাতে পারে। যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ক্রয় এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনার কারণে সম্ভব হতে পারে। 


বাংলাদেশি প্রেক্ষাপট: বিনিয়োগের সুযোগ না বিপদ?


বাংলাদেশেও স্বর্ণ দীর্ঘদিন ধরেই মূল্য সংরক্ষণের মাধ্যম হিসেবে পরিচিত। তবে সাম্প্রতিক বৈশ্বিক পরিস্থিতি স্থানীয় বাজারেও প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। এরমধ্যেই দেশে স্বর্ণের দাম প্রতি ভরি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার ওপরে উঠেছে।


বিনিয়োগকারী ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বর্ণে বিনিয়োগ করতে চাইলে বাজার পরিস্থিতি বুঝে ধাপে ধাপে এগোনো উচিত। বিশেষ করে যেহেতু স্বর্ণে তাৎক্ষণিক লভ্যাংশ মেলে না, তাই এটি দীর্ঘমেয়াদি নিরাপদ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করলেই ভালো।

 

আরও পড়ুন: দাম সমন্বয়ে স্বর্ণের ‘হাফসেঞ্চুরি’, ভরি ছাড়াতে পারে ২ লাখ টাকা!


বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিংয়ের চেয়ারম্যান ও বাজুস সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান সময় সংবাদকে বলেন, চলতি মাসে অস্থির হয়ে উঠছে বাজার। এর পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার কমানোর সম্ভাবনা জোরালো হওয়া। পাশাপাশি বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো আগের তুলনায় স্বর্ণ মজুতের পরিমাণ কিছুটা বাড়িয়েছে। যার প্রভাবে বিশ্ববাজারে রেকর্ড দামে পৌঁছেছে স্বর্ণ। দেশেও স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে।


দেশের বাজারে দাম সমন্বয় প্রসঙ্গে তিনি জানান, বিশ্ববাজারে ঘণ্টায় ঘণ্টায় দাম হলেও দেশে সেটি হয় না। অন্তত একদিনের ব্যবধানে দাম সমন্বয় করা হয়। শুধু বাংলাদেশেই না, বিশ্ববাজারে ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর সব দেশেই দাম সমন্বয় করতে বাধ্য হয়। তবে চলতি বছর এত দ্রুত এত বেশি বার দাম সমন্বয় হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোলান্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতির প্রভাবে বিশ্ববাজার দোলাচলে থাকার কারণে।


স্বর্ণের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে জানিয়ে মাসুদুর রহমান বলেন, স্বর্ণের দাম প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার ওপরে। বিশ্ববাজারে অস্থিরতা চলতে থাকলে এটি ২ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। ঊর্ধ্বমুখী এই দামে কমে গেছে বেচাকেনা, বেকার হয়ে পড়ছেন কারিগররা। তবে বিশ্ব পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে দাম কমে আসতে পারে।


সূত্র- খালিজ টাইমস ও রয়টার্স

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন