বাকৃবি গবেষকদলের জৈব ছত্রাকনাশক উদ্ভাবন, রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমাবে ২৫ শতাংশ

১ সপ্তাহে আগে
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক দেশের মাটি থেকে সংগ্রহ করা উপকারী ছত্রাক ব্যবহার করে উদ্ভাবন করেছেন একটি পরিবেশবান্ধব জৈব ছত্রাকনাশক, যা একইসঙ্গে জৈব সার হিসেবেও কাজ করতে সক্ষম। গবেষকদের দাবি, ‘পি.জি. ট্রাইকোডার্মা’ নামের এই নতুন ছত্রাকনাশকের ব্যবহার ফসলে ছত্রাকজনিত রোগ প্রতিরোধে কার্যকর হওয়ার পাশাপাশি ফসল উৎপাদন ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারে এবং রাসায়নিক সার প্রয়োগ ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমানো সম্ভব।

বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বাড়লেও বালাইনাশকের অতিরিক্ত এবং অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। বর্তমানে ব্যবহৃত বালাইনাশকের মধ্যে ৪৫ থেকে ৪৬ শতাংশই ছত্রাকনাশক, যা মাটি, পানি ও বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ।


উদ্ভাবনের নেতৃত্বে থাকা বাকৃবির উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহজাহান মঞ্জিল জানান, ছত্রাকনাশকটির মূল উপাদান ট্রাইকোডার্মা এস্পেরেলাম, যা বাংলাদেশের বিভিন্ন কৃষি অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা মাটি ও রাইজোস্ফিয়ার থেকে শনাক্ত ও আলাদা করা হয়েছে। দেশের মাটিতে অভিযোজিত এই অণুজীব আন্তর্জাতিকভাবে জিন সিকুয়েন্সিং করে স্বীকৃতি পেয়েছে বলেও জানান তিনি।


ড. মঞ্জিল বলেন, পি.জি. ট্রাইকোডার্মা শুধুমাত্র ছত্রাকনাশক নয়, এটি ফসফেট দ্রবীভবন, নাইট্রোজেন দক্ষতা বৃদ্ধি ও ভারী ধাতু দূষিত মাটিতে নিরাপদ চাষে কার্যকর। পাশাপাশি এটি উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে শিকড়ের বৃদ্ধি, পুষ্টি গ্রহণ এবং পরিবেশগত চাপ সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ায়।


পি.জি. ট্রাইকোডার্মা ব্যবহারে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি সম্পর্কে অধ্যাপক শাহজাহান মঞ্জিল বলেন, ছত্রাকনাশকটির প্রয়োগে আমরা ছত্রাকজনিত রোগ প্রতিরোধের পাশাপাশি বিভিন্ন ফসলের উল্লেখযোগ্য ফলন বৃদ্ধি লক্ষ্য করেছি। টমেটো, আলু ও বেগুনে ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২০-২৫ শতাংশ, পালং ও পুঁইশাকে ফলন বেড়েছে ৪০-৫০ শতাংশ, পানে ফলন বেড়েছে প্রায় ৪৫-৫০ শতাংশ, চা গাছে ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে ৮০-১০০ শতাংশ, ঢেঁড়স, মরিচ ও শসায় ফলন বেড়েছে ১৫-২০ শতাংশ। ডাল, ধান ও ফলগাছে রোগ দমন ও গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকায় ফলন স্থিতিশীল বা ধীরে ধীরে বৃদ্ধির ধারা দেখা যাচ্ছে।


অধ্যাপক মঞ্জিল আরও বলেন, পি.জি.ট্রাইকোডার্মা গোড়াপঁচা, কান্ডপঁচা, পাতাপঁচা ও ব্লাইট দমনে কার্যকর, শিকড়ের বৃদ্ধি ও পুষ্টি গ্রহণ বাড়িয়ে ফসলের উৎপাদন ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায়। এটি ছাদ কৃষি ও মৎস্য চাষেও উপযোগী যা কৃষকের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক।


আরও পড়ুন: টেকসই কৃষিব্যবস্থায় জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি কেন?


এই ছত্রাকনাশক জলজ পরিবেশে ব্যবহার করেও কোনো নেতিবাচক প্রভাব পাওয়া যায়নি। বাকৃবির অ্যাকুয়াকালচার বিভাগ সহযোগিতায় পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, পি.জি. ট্রাইকোডার্মার প্রয়োগে মাছের ওজন ও আকার বৃদ্ধি পেয়েছে, পানির গুণমান উন্নত হয়েছে এবং প্যাথোজেনিক ছত্রাক হ্রাস পেয়েছে।


মৌলভীবাজারের ফুলতলা টি এস্টেটের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার শিহাব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমি পি.জি. ট্রাইকোডার্মা ব্যবহার করে পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ ফলন পেয়েছি। আগে যেসব রাসায়নিক ব্যবহার করতাম, সেগুলো এখন অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছি।


ময়মনসিংহ বিভাগীয় কৃষি অফিসের অতিরিক্ত পরিচালক ড. সালমা লাইজু বলেন, এই উদ্ভাবন কৃষি, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য আশাব্যঞ্জক। এটি কৃষি অফিস থেকে সরবরাহযোগ্য হলে সাধারণ কৃষকের জন্য অনেক উপকারী হবে।


২০০১ সাল থেকে গবেষণার শুরু হলেও গত বছর বিশ্ব ব্যাংক ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় প্রকল্পটির উন্নয়ন ও পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়। বর্তমানে বাণিজ্যিক নিবন্ধনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে প্রযুক্তিটি।


গবেষকরা জানান, যথাযথ গবেষণা বরাদ্দ পেলে ভবিষ্যতে জৈব কীটনাশক ও বহুমুখী বালাইনাশক উদ্ভাবনের পরিকল্পনা রয়েছে।
 

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন