জিলহজ মাসের ৯ তারিখকে ইয়াওমে আরাফা বলা হয়। আর হাদিস শরিফে আরাফার রোজার অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন, এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ إِنِّي أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ، وَالسَّنَةَ الَّتِي بَعْدَهُ অর্থ: আরাফার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহ পাকের কাছে আশাবাদী যে, তিনি এর দ্বারা এক বছর আগের এবং এক বছর পরের অর্থাৎ দুই বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। (তিরমিজি: ৭৪৯)
বাংলাদেশে আরাফার রোজা আমরা কবে রাখব?
এ বিষয়টি নিয়ে জনমনে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কারণ, হাজী সাহেবরা যখন আরাফার মাঠে অবস্থান করেন, তখন আমাদের দেশের সাধারণ মুসলমানগণ মনে করেন যে, হাজী সাহেবরা আরাফার মাঠে অবস্থান করছেন; সুতরাং আজই আমাদের আরাফার রোজা রাখতে হবে। অথচ সময়ের অসম্ভব ব্যবধানের কারণে সৌদির সাথে মিলিয়ে আরাফার রোজা রাখা সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন: ওমরার ফরজ ও ওয়াজিব কী কী
কারণ, সব সময় চন্দ্র মাসের হিসেবে সৌদির সাথে বাংলাদেশের অন্ততপক্ষে এক দিনের ব্যবধান হয়ে থাকে। যার কারণে যেদিন সৌদিতে জিলহজের ৯ তারিখ এবং আরাফা হয়, সেদিন বাংলাদেশে ৮ তারিখ থাকে। বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে হাজীদের আরাফার ময়দানে অবস্থান অবলোকনের ফলে এ প্রশ্নটি অন্তরে ঘুরপাক খেতে থাকে।
অন্যদিকে, যেদিন বাংলাদেশে জিলহজের ৯ তারিখ হয়, সেদিন সৌদিতে ১০ তারিখ, অর্থাৎ ঈদুল আজহার দিন। এ দিনকে সৌদির সাথে হিসাব করলে বাংলাদেশে রোজা রাখা হারাম হয়ে যায়।এভাবেই আরাফার রোজা সম্পর্কে সাধারণ মুসলমানদের মনে চরম সন্দেহ-সংশয় ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। এ জাতীয় সকল সন্দেহ-সংশয় ও বিভ্রান্তি দূর করার জন্য আমরা কয়েকটি কথা বলছি। গভীরভাবে পাঠ করলে এ বিষয়ে সকল বিভ্রান্তি দূর হয়ে যাবে এবং সঠিক পথ ও পন্থা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বুঝার তাওফীক দান করুন, আমিন।
এক. আরাফার রোজা চন্দ্রের হিসাবের মাস জিলহজের সাথে সম্পৃক্ত। এটি সৌর মাস যেমন—জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, কিংবা সাপ্তাহিক হিসাবের দিন যেমন—শনিবার, রবিবার ইত্যাদির সাথে সম্পৃক্ত নয়।
দুই. আরাফার রোজা জিলহজ মাসের ৯ তারিখের সাথে সম্পৃক্ত। সুতরাং পৃথিবীর যেখানে যখন জিলহজের ৯ তারিখ হবে, সেখানেই তখন আরাফার রোজার সময় হবে। রোজা রাখতে ইচ্ছুক ব্যক্তিগণ রোজা রেখে উক্ত সওয়াব অর্জন করতে পারবেন।
তিন. সময়ের সাথে সম্পৃক্ত যত ইবাদত আছে—যেমন: নামাজ, রোজা এবং ইবাদতের সময় নির্ধারণের মাধ্যম—সূর্য-চন্দ্র ও দিন-রাত—সবই পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে আবর্তিত হয়। সকল ইবাদতের সময় পূর্ব দিক থেকে শুরু হয়ে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَّهَا ۚ ذَٰلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ ۞ وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ حَتَّىٰ عَادَ كَالْعُرْجُونِ الْقَدِيمِ ۞ لَا الشَّمْسُ يَنبَغِي لَهَا أَن تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلَا اللَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ ۚ وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ (সুরা ইয়াসিন: ৩৭–৪০)
অর্থ: সূর্য নিজ নির্ধারিত গণ্ডির মধ্যে আবর্তিত হয়—এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহর নির্ধারণ। আর চাঁদের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি বিভিন্ন মনযিল; অবশেষে তা পুরাতন খেজুর শাখার মতো হয়ে যায়। সূর্যের পক্ষে চাঁদের নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়, রাতেরও পক্ষে দিনকে অতিক্রম করা সম্ভব নয়। আর প্রত্যেকে নিজ নিজ কক্ষপথে আবর্তিত হচ্ছে।
এই আয়াতগুলো দ্বারা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় সূর্য, চন্দ্র, দিন ও রাত পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে চলছে। যেমন: বাংলাদেশের পশ্চিমে পাকিস্তান, তার পশ্চিমে ওমান, এরপর সৌদি, তারপর মিশর, তিউনিসিয়া ইত্যাদি। সূর্য প্রথমে বাংলাদেশে ওঠে, এরপর পশ্চিমমুখী হয়। নামাজের সময় ও দিন-রাত প্রথমে পূর্ব দিকে শুরু হয়। চাঁদের গতিও পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে। চাঁদ যেদিকে দৃশ্যমান হতে থাকে, সেই দিকেই ইবাদতের সময় আবর্তিত হয়।
চার. সুতরাং সৌদিতে যখন আরাফার দিন শুরু হবে, তখন তা পশ্চিম দিকে ঘুরে ঘুরে ২১ ঘণ্টা পর বাংলাদেশে আসবে এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফার সময় থাকবে। এটাই শরিয়তের বিধান, যা বিজ্ঞানও সমর্থন করে। পাঁচ. আপনি যদি বলেন, হাজিরা যেদিন আরাফার ময়দানে থাকবেন আমি সেদিন রোজা রাখব—তাহলে আপনাকে সৌদি আরব চলে যেতে হবে। কারণ: বাংলাদেশে দুপুর ১২টা হলে, তখন সৌদিতে সকাল ৯টা। অথচ আরাফার উকুফ শুরু হয় যোহরের পর।
সৌদিতে যখন সন্ধ্যা ৬টা, বাংলাদেশে তখন রাত ৯টা। অস্ট্রেলিয়ার সাথে সৌদির ৭ ঘণ্টা ব্যবধান। উকুফের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ায় রাত হয়ে যায়। পশ্চিমা দেশেও সময়ের ব্যবধানের কারণে মিলানো সম্ভব নয়। সৌদির বিপরীত অঞ্চলে যেমন আলাস্কা বা আমেরিকায় সময়ের এত পার্থক্য যে, একসাথে মিলিয়ে রোজা রাখা অসম্ভব। অর্থাৎ, সৌদির আরাফার সাথে পুরো দুনিয়া মিলিয়ে রোজা রাখা অসম্ভব। আর ইসলাম অসম্ভব বিষয়ে আদেশ দেয় না।
আরও পড়ুন: বিশ্বের যে ৫ মসজিদ পর্যটকদের কাছে বিস্ময়ের
ছয়. যদি আরাফার রোজা ময়দানে অবস্থানের কারণে হতো, তাহলে অবস্থানকারীদের জন্য রোজা রাখা উত্তম হতো। অথচ তাদের জন্য এই রোজা রাখা মাকরুহ। এ থেকে প্রমাণিত হয়, এটি আরাফার ময়দানে অবস্থানের কারণে নয়; বরং এটি ইয়াওমে আরাফা, অর্থাৎ নবম জিলহজের রোজা।
সাত. সৌদি থেকে পশ্চিমে আবর্তিত হতে হতে ১৮০° দ্রাঘিমায় এসে দিনের নাম ও ইংরেজি তারিখ পরিবর্তন হয়ে যায়। যেহেতু আরাফার রোজা ইংরেজি তারিখ ও বার অনুযায়ী নয়, তাই এতে কোনো সমস্যা হয় না।
উপরে আলোচনার মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে গেল, আরাফার রোজা চন্দ্র তারিখের সাথে সম্পৃক্ত। আর আরাফার ময়দানে হাজীদের অবস্থানের সাথে মিলিয়ে সমগ্র পৃথিবীতে রোজা রাখা অসম্ভব। ইসলাম অসম্ভব বিষয়ের আদেশ দেয় না। সুতরাং পৃথিবীর যে স্থানে যখন জিলহজ মাসের ৯ তারিখ হবে, তখনই রোজা রাখার ইচ্ছা পোষণকারীরা রোজা রাখবে।
লেখক: শিক্ষক, লালবাগ মাদ্রাসা, ঢাকা, খতিব, আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ, ঢাকা, পরিচালক, দাওয়াতুস সুন্নাহ বাংলাদেশ
]]>