বাঁশে রান্না ‘ব্যাম্বু চিকেন’ এত জনপ্রিয় কেন?

৩ সপ্তাহ আগে
বাঁশে রান্না অথবা খাবার হিসেবে বাঁশ রান্নার খবরটি খুব কম মানুষের-ই জানা। সত্যি সত্যিই যদি বাঁশে রান্না কিংবা তরকারি হিসেবে বাঁশ এর কথা বলা হয়; তবে অনেকেই অবাক হবেন হয়তো। কিন্তু একদম খাটি কথা হলো- পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র আদিবাসি বা পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের কাছে বাঁশে রান্না করা খাবারই সবচেয়ে প্রিয়।

আবার কেবল কড়াইয়ের পরিবর্তে বাঁশে রান্না করাই নয়; মজাদার তরকারি হিসেবেও ‘বাঁশ’ এর কদর রয়েছে। যদিও এই ব্যবস্থাটি পাহাড়ি জীবনের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী অনুসঙ্গ বিশেষ। বাঁশে রান্না করা খাবারগুলোর মধ্যে ‘ব্যাম্বু চিকেন’ সবচেয়ে জনপ্রিয় রেসিপি।


এটা ঠিক, দিনে দিনে বাঁশে রান্না করে খাওয়ার প্রচলন কমছে। আদিবাসি সমাজে অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। এরমধ্যেও পাহাড়িদের কিছু কিছু পরিবার প্রাকৃতিক উপায়ে রান্নার ধরণটি টিকিয়ে রেখেছেন। বিশেষত: জুমচাষনির্ভর আদিবাসিরা একদিকে ঐতিহ্য হিসেবে অন্যদিকে রাঁশে রান্নায় মজাদারের কারনে তা ধরে রাখেন। ব্যতিক্রমী হিসেবে শহরে বসবাসকারি হাতেগোনা কিছু পাহাড়ি পরিবারকে কদাচিৎ বাঁশে রান্না করে খেতে শোনা যায়। তাদের মধ্যে জেলা সদরের খাগড়াপুরের হাদুকপাড়ার সাহিত্যিক গবেষক প্রভাংশু ত্রিপুরার নাম উল্লেখ করা যায়।


আদিবাসি গবেষক প্রভাংশু ত্রিপুরা জানালেন, বাঁশে রান্নার ধারণা নতুন কিছু নয়। মানুষ যখন থেকে রাধতে শিখেছে, তখন থেকেই বাঁশে রান্নার প্রচলন শুরু। আদিম যুগে পুড়িয়ে খেতে শেখার পরই ধাপেই বাঁশে, তারপর মাটির হাড়িতে রান্না করতে শুরু করে মানুষ। উন্নতির ছোঁয়ায় কেউ কেউ রান্না পদ্ধতি পরিবর্তন করেছে মাত্র। প্রান্তিক মানুষরা আজ হাজার বছর পরও সেই বাঁশেই রান্না করে খেতে দেখা যায়।


আরেক গবেষক মংসানু মারমার মতে, কেবল জীবনমান উন্নয়নের কারণেই মানুষ বাঁশে রান্না ছেড়ে আধুনিক নানা উপকরণে করছেন তা নয়। বাঁশের চুঙ্গায় রান্না-বান্নায় স্বাদই আলাদা। সুস্বাদু। চমৎকার সুঘ্রাণ। তিনি জানান, বিশেষত: প্রত্যন্ত এলাকার ত্রিপুরা ও মারমা নৃ-গোষ্ঠীর পাহাড়িরা এখনও বাঁশে যাবতীয় রান্না করে খেয়ে থাকেন।


আজকাল দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষন হলো- বাঁশে রান্না পাহাড়ি খাবার-দাবার এবং বাঁশ কড়–লের তরকারি। চাহিদা এমন বেশি যে, পাহাড়ে বেড়াতে এলে বাঁশের রেসিপি খাদ্য তালিকায় থাকবেই। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- বেম্বো চিকেন, ছোট মাছ, গুদায়া, শাক-সবজি, ভাত প্রভৃতি।
জনপ্রিয় বেম্বো চিকেন:

আরও পড়ুন: রেস্টুরেন্ট স্টাইলে সুস্বাদু চিলি সয়া রেসিপি

ব্যাম্বু চিকেন। এক প্রকার পাহাড়ি রেসিপি। ক্ষুদ্র নৃ-তাত্তিক মানুষের কাছে এটি নিয়মিত ব্যাপার হলেও অন্য জনগোষ্ঠির মানুষের জন্যে আলাদা কিছু। ব্যাম্বু চিকেন বা বাঁশে রান্না করা মুরগির মাংসের কথা বলছি। বিশেষ পদ্ধতির এই খাবারটি দিনে দিনে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পর্যটক হলে তো কথাই নেই। পাহাড়ে বেড়াতে আসলেই আগন্তুক পর্যটক খেতে চান বেম্বো চিকেন। এটি এত মজা, এত মজা, এত মজা যে, শুনলেই যে কারো জিভে জল এসে যায়। স্বাদ, গন্ধ আর ভিন্ন ধরনের ফ্লেভারের কারনে বেম্বো চিকেন এর এত বিশেষত্ব।


কী ধরনের বাঁশে ভালো রান্না হয়; তা নিয়ে বিতর্ক আছে। অবিতর্কিত ব্যাপারটা হলো অবশ্যই তা হবে কাচা বাঁশ। কাচা এজন্যই যে, বাঁশ কাঁচা না হলে দ্রুতই আগুনে পুড়ে যাবে। আপনার উপকরণ সিদ্ধ হবে না। বিশেষ করে ডুলু আর মুলি বাঁশেই রান্না ভালো হয়। অপেক্ষাকৃত মোটা বাঁশকে গিরা রেখে চাহিদামত কেটে নিন। এরপর বাঁশ চুঙ্গাটি সামান্য পানিতে ধুয়ে নিলে ভালো।
রন্ধনশৈলী:


বাঁশে রান্না করার নিয়ম-কানুন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতও আছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিল রয়েছে। রান্নার প্রনালী সম্পর্কে কথা হয়েছে খাগড়াছড়ির পরিচিত আদিবাসি খাবার রেষ্টুরেন্ট ‘সিসটেম’ এর উদ্যোক্তা মংসানু মারমা (মং) এবং মজাদার খাবার তৈরীতে বিশেষ পারদর্শী প্রতিভা ত্রিপুরার সাথে। তারা জানালেন বেম্বো রেসিপি‘র আদ্যপান্ত।


প্রতিভা ত্রিপুরা তার ঘরে যেভাবে বেম্বো চিকেন তৈরি করেন, তার রেসিপি হলো- আধা কেজি ওজনের দেশি মুরগি। হালালমত জবাই করুন। এরপর ছোট ছোট পিস করুন। ভালোভাবে ধুয়ে নিন। পিয়াজ কুচি, আদা বাটা, হলুদ, মরিচ, ধনিয়াপাতাসহ পরিমানমত তেল ও লবন মিশিয়ে আঙ্গুলের ছিটকা পানিতে মাংসের সাথে ভালো করে মাখিয়ে নিন। মনে রাখবেন, মরিচ হবে কাচা এবং তা হবে আধাবাটা। অন্তত ১০/১৫ মিনিট মাখিয়ে রাখতে হবে। এরপর কাচা বাঁশের চুঙ্গার মধ্যে মাখানো মাংস ডুকিয়ে কলাপাতা দিয়ে মুখ বন্ধ করতে হবে। সব ঠিকঠাক থাকলে-


এখন বাঁশটি আগুনের কয়লায় বসিয়ে দিন। মনে রাখবেন, প্রবেশদ্বারটি কমপক্ষে থার্টি এঙ্গেল উপরে রাখবেন। এরপর আগুনের ছেকা শুরু। এরপর আগুনের তাপ বিবেচনায় বাঁশটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিন। এভাবে মুরগি বা পাখি জাতীয় মাংস রাঁধতে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট সময় লাগতে পারে। তবে ভাঁপ বের হবার পর ফ্লেভার পেলেই বুঝবেন, বেম্বো চিকেন রেসিপি হয়ে গেছে। গ্যাসের আগুনেও বেম্বো চিকেন করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার হলো- রেসিপি মজাদার করতে কখনোই অন্য কোন ধরনের মসলা ব্যবহার করা যাবেনা। এতে বেম্বো চিকেন খাবার অনুপযোগি হয়ে যেতে পারে। এটিও বেম্বো চিকেনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কেবল বেম্বো চিকেনই নয়; মাছ, ডিম, শাক-সবজি ও ভাত বাঁশে রান্না খুব টেস্টি হয়ে থাকে। জেনে রাখা ভালো যে, আশযুক্ত কোন খাদ্যই বাঁশে রান্না করা যাবেনা। পাহাড়িদের ‘বাঁশে গুদায়া’ অন্যতম সুস্বাদু খাবার। বাঁশে পিঠাপুলিও হয়ে থাকে। মারমাদের ‘কেদামু’ অন্যতম।

আরও পড়ুন: বিয়ে বাড়ি স্টাইলে চিকেন রোস্ট রেসিপি

খাগড়াছড়ির পরিচিত পাহাড়িয়া রেস্টুরেন্ট সিসটেম, খাংময়, ইজর, টং, জুমঘরসহ সব ক‘টি রেস্তোরায় বেম্বো চিকেন পাওয়া যায়। তবে, সিসটেম রেস্টুরেন্ট এর ‘বেম্বো চিকেন’ এর বেশ সুনাম আছে।


জেলা সদরের পানখাইয়াপাড়ার ‘সিসটেম রেস্টুরেন্ট’ এর মং দাদা বলেন, ‘ইদানিং বেম্বো চিকেন এর অর্ডার খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষত: শুক্র, শনিবার খাগড়াছড়িতে পর্যটক এলে প্রথমেই বেম্বো চিকেন খেতে চান। অর্ডার পেলে আমরা যথাসম্ভব কম দামে তা পরিবেশন করি। তবে, কাচা বাঁশ সংগ্রহ করতে সমস্যায় পড়তে হয়।’


ঢাকা থেকে সাজেক বেড়াতে আসা ব্যবসায়ি নুর হোসেন পল্লব এর সাথে শনিবার রাতে দেখা হয় সিসটেম রেস্তোরায়। আরো বন্ধুদের নিয়ে তিনি বেম্বো চিকেন খাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, ‘এমন প্লেভারের খাবার আগে কখনো খাইনি। পাহাড়ি এই রেসিপি এমন মজা হতে পারে আগে ভাবিনি।’

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন