বগুড়ার দুই নদী ‘নিখোঁজ’, সন্ধান চাইলেন পাউবোর প্রকৌশলী

৩ সপ্তাহ আগে
দেশের নদীর অভিভাবক হিসেবে বিবেচিত পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বগুড়ার ২৯ কিলোমিটার ঘড়িয়া ও ১৯.৫ কিলোমিটার চন্দ্রাবতী নামে দুই নদী নিখোঁজের খবর দিয়েছে। স্থানীয় লোকজনের বরাতে সংস্থাটি বলছে, এই দুই নামে বগুড়ায় কোনো নদী নেই।

কিন্তু ২০০৯ সালে বগুড়া জেলা প্রশাসনের প্রকাশিত বই অনুয়ায়ী, চন্দ্রাবতী নামে নদী রয়েছে দুপচাঁচিয়ায়। আর বাংলাদেশের নদনদী নামক বইয়ের সূত্রে উল্লেখ রয়েছে, ঘড়িয়া নদীর অবস্থান রয়েছে বগুড়ার গাবতলীতেই।
 

এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ নদী নিখোঁজের বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডে নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হক বলেন, ‘যদি কেউ নদী সন্ধান পায় তাহলে আমাদের জানাতে পারেন। তখন আমরা সেগুলো নদীর তালিকায় যোগ করব।’


পাউবো সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বগুড়ার নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা, নদীকে অবৈধ দখল ও দূষণমুক্তকরণ সংক্রান্ত বিশেষ সভা ও জেলা পানি সম্পদ উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা হয়। এখানে জেলার শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতামতের ভিত্তিতে বগুড়ায় মোট ২৩ টি নদ-নদীর সংখ্যা চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য করেন। এ সিদ্ধান্ত মোতাবেক একটি তালিকা করে পাউবো। এ তালিকায় বগুড়ার অন্যান্য নদ-নদীর নাম থাকলেও ঘড়িয়া ও চন্দ্রাবতীর নাম উল্লেখ নেই।

আরও পড়ুন: রাজশাহীতে ফিটনেসবিহীন গাড়ির দৌরাত্ম্য, ১২ মাসে ৩৮০ জনের মৃত্যু

বগুড়া পাউবোর একটি সূত্র জানায়, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে দেশের নদ-নদীর একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করার জন্য বগুড়া পাউবোর কাছে নদ-নদীর সংখ্যা চাওয়া হয়। সেখানে জেলায় ২৩ টি নদীর নাম দেয়া হয়। তালিকায় ঘড়িয়া ও চন্দ্রাবতীর নাম ছিল না। এর আগের তালিকাগুলোতে এই দুটি নদীর নাম ছিল বলে পাউবোর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান।


আবার জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রকাশিত নথিতেও বগুড়ার ঘড়িয়া ও চন্দ্রাবতীর নাম আছে। পরে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে বগুড়ার এই দুই নদী বাস্তবে আছে কিনা তা সরেজমিন ও রেকর্ডপত্র এবং বাস্তবতার ভিত্তিতে যাচাই করে মতামত দেয়ার জন্য বগুড়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের ‘বাদকৃত নদীর পুনঃযাচাই কমিটি’ গঠন করে চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি।
 

কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন বগুড়া পাউবোর উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আসাদুল হক, সরকারি মজিবুর রহমান মহিলা কলেজের  সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. রেজাউন নবী, জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সহকারি কমিশনার আবু শাহামা ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বগুড়ার শাখার সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান।
 

কমিটি গঠনের পরের দিনে অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রথমে ঘড়িয়া নদীর সন্ধানে বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার নেপালতলী এলাকায় ও সারিয়াকান্দি উপজেলার বড়িয়া এলাকা পরিদর্শন করেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
 

চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিভাগীয় কমিশনারের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে কমিটি উল্লেখ করেন, নেপালতলী এলাকার স্থানীয় লোকজন জানান, ঘড়িয়া নামে কোনো নদী এ এলাকায় নেই। সারিয়াকান্দির বড়িয়ায় স্থানীয় জনগণও একই তথ্য দেন। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড দাবিকৃত ৭২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ইছামতি নদীর ভাটির ভাটির দিকের অংশবিশেষ ঘড়িয়া নদী হতে পারে, এটিও স্থানীয়দের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে জানিয়েছে কমিটি।

আরও পড়ুন: বগুড়ায় হত্যার দুই যুগ পর আসামির যাবজ্জীবন
 

তদন্ত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, কমিটির সদস্যগণ চন্দ্রাবতী নদীর সন্ধানে বগুড়া জেলার দুপচাঁচিয়া উপজেলায় ইরামতি নদীর ইসলামপুর এলাকা এবং চৌমুহনী এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজন এবং স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যানের জানান, দুপচাঁচিয়া উপজেলা থেকে দুইটি নদী আদমদীঘি উপজেলার দিকে ধাবিত হয়েছে। একটি নাগর নদী, যা আত্রাই নদীতে পতিত হয়েছে।  অন্যটি ইরামতী নদী, যা আদমদীঘি উপজেলার রক্তদহ বিলে মিশেছে।  স্থানীয় লোকজন জানান, চন্দ্রাবতী নামে কোনো নদী এই উপজেলায় নেই।
 

সরেজমিন ও রেকর্ডপত্র এবং বাস্তবতার ভিত্তিতে যাচাই করে এই কমিটি একটি মতামত প্রকাশ করেন। 

 

সেখানে উল্লেখ করেন, কমিটির পরিদর্শন ও তথ্য পর্যালোচনা করে প্রতীয়মান হয়, যে ঘড়িয়া ও চন্দ্রাবতী নামে কোন নদীর অস্তিত্ব নেই। এবং বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে চন্দ্রাবতি ও ঘড়িয়া নদী পাওয়া যায়নি।  সুতরাং বগুড়া জেলায় চূড়ান্ত নদীর সংখ্যা ২৩ টি।
 

২০০৯ সালে বগুড়ার জেলা প্রশাসন প্রকাশিত ‘ধুনট থেকে দুপচাঁচিয়া ঐতিহ্য সমৃদ্ধ জনপদ’ বইয়ে প্রফেসর ড. মো. আবু হানিফ শেখ ও প্রফেসর মো. মোখলেছুর রহমান ‘বগুড়া জেলার নদ-নদী’ শিরোনামের লেখায় চন্দ্রাবতী নদীর কথা উল্লেক করেছেন।  নদীর বর্ননায় বলা হয়েছে, দুপচাঁচিয়া থানার চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিমে গুনাহর ইউনিয়নে উৎপত্তি হয়ে আদমদীঘি থানার নসরৎ হয়ে নওগাঁ জেলার রাণীনগর থানার আত্রাই নদীতে পড়েছে চন্দ্রাবতি নদী। এর দৈর্ঘ্য ১০ থেকে ১২ মাইল। জেলা প্রশাসন প্রকাশিত বইয়ে চন্দ্রাবতী নদীর বিস্তারিত বর্ণনা সহকারে উল্লেখ থাকলেও তদন্ত কমিটি তা এড়িয়ে গেছেন। 
 

আর উত্তরাঞ্চলের বিখ্যাত নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকি জানান, বগুড়ায় অন্তত ২৯ টি নদী রয়েছে। এর মধ্যে একটি ঘড়িয়া। এটি বগুড়ার গাবতলীর ইছামতি নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে বাঙ্গালি নদীতে পতিত হয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন প্রকাশিত বাংলাদেশের নদ নদী বইয়ের ২৪৬ নম্বরে এই নদীর নাম উল্লেখ রয়েছে।
 

বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক এক নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী) জানান, ‘নদীর খোঁজ করার জন্য স্থানীয় লোকজনের চেয়ে সিএস ম্যাপ খুব উপযোগী। স্থানীয় ভূমি রেকর্ড ও ম্যাপ বলে দেবে এ অঞ্চলে নদী ছিল না। এটি সঠিক পদ্ধতি। নদী নিখোঁজ দেখানোর অর্থ হলো, ওই নদীগুলোর জমি প্রভাবশালীদের দখল করতে সহযোগিতা করা।’

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন