বন্যার ধ্বংসযজ্ঞ যেন এক পরিচিত পুনরাবৃত্তি— বছর বছর ফিরে আসে একই দুর্যোগ, আর থেকে যায় দগদগে ক্ষত। প্রশ্ন উঠে, আমরা কি এখনো প্রস্তুত নই?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান স্বভাবতই বন্যাপ্রবণ, কিন্তু শুধু প্রাকৃতিক কারণ দেখিয়ে দায় এড়ানো যায় না।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মাসফিকুস সালেহিন বলেন, ‘উজানের ঢল, নদীর নাব্যতা হারানো এবং অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় প্রতিবছর বন্যা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।’
তার মতে, আগাম সতর্কতা, কার্যকর পূর্বাভাস এবং পুনরুদ্ধার পরিকল্পনায় ঘাটতি আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
সরকারি ও বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী—
- ২০২২ সালে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ প্রায় ৭০ লাখ। প্রাণহানি হয়েছে প্রায় ১৪৫ জনের এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা।
- ২০২৩ সালে সিলেট, সুনামগঞ্জ, কুড়িগ্রামসহ ২০ জেলার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। আর এতে প্রাণহানি হয়েছে প্রায় ৯৮ জনের। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষিজমি ২ লাখ একরের বেশি।
- ২০২৪ সালে ঘূর্ণিঝড়ের পরপরই ভয়াবহ নদীভাঙন দেখা দেয়। এতে হাজারো বাড়ি-ঘর ভেসে গেছে। বিশুদ্ধ পানির অভাব, ডায়রিয়ায় শিশুর মৃত্যু, সব মিলে ক্ষয়ক্ষতি প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা।
২০২৫ সালে চলতি বছরেও বর্ষা শুরু হতেই দেশের নানা অঞ্চলে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন ও বন্যার ঝুঁকি। এখনও অনেক অঞ্চলে উপযুক্ত বাঁধ নেই, নেই কার্যকর ড্রেনেজ ব্যবস্থা কিংবা দুর্যোগপূর্ব প্রস্তুতি।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশের পানি সংকট: এক নীরব বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মাসফিকুস সালেহিন বলেন,
দেশের ভেতরের নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তন, খাল-জলাশয় ভরাট এবং অবৈধ দখলের ফলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি, নদীগুলোতে পলি জমে ক্রমেই নাব্যতা হারিয়ে ফেলছে— সবকিছু মিলিয়েই বন্যার মাত্রা দিনকে দিন বাড়ছে।
ক্ষয়ক্ষতি কমানোর উপায় হিসেবে তিনি জোর দেন ফরকাস্টিং ও আরলি ওয়ার্নিং সিস্টেমের ওপর।
আর কুয়েটের সহকারী অধ্যাপক ড. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘খুলনা অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণের দুর্নীতি, পরিকল্পনার অভাব ও স্থানীয় সম্পৃক্ততার ঘাটতি প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’
তিনি মনে করেন, পুরনো পোল্ডার সংস্কার, জলাশয় সংরক্ষণ এবং অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা ছাড়া কোনো টেকসই সমাধান সম্ভব নয়।
একই সুরে কথা বলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তৌফিকুল ইসলাম। তার মতে, ‘পলিব্যাগ দিয়ে বাঁধ বানানো এখনো চলমান থাকলে, প্রতিবছরই নতুন করে ভাঙনের গল্প শুনতে হবে।’
একইভাবে চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহের বন্যায় বিপর্যস্ত বন্যাকবলিত মানুষ এবং নদী ভাঙনের কড়াল গ্রাসে আচ্ছন্নে সেখানকার জনপদ।
প্রতিবারই বন্যা আসে, ত্রাণ যায়, মানুষ কিছুদিনের জন্য টিকে থাকে। কিন্তু স্বপ্ন আর স্থায়ী জীবিকা হারায় চিরতরে। এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন—
- বিজ্ঞানভিত্তিক, বাস্তবসম্মত পানি ব্যবস্থাপনা
- সময়মতো আগাম সতর্কতা ও পুনর্বাসন
- প্রকৃতিনির্ভর টেকসই বাঁধ ও খাল পুনঃখনন
- রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দুর্নীতিমুক্ত বাস্তবায়ন
- সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানো
বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটা আমাদের দায়িত্ববোধের ব্যর্থতা। বন্যা থামানো যাবে না, কিন্তু তার আঘাত কমানো সম্ভব। প্রতি বছরই যখন কেউ তার শেষ সম্বল হারায়, তখন প্রশ্ন ওঠে— আমরা কি সত্যিই উন্নত হচ্ছি? এই দেশ আমাদের, এই মানুষগুলো আমাদের; তাদের রক্ষা করাই আমাদের সত্যিকারের উন্নয়ন।
]]>