পাহাড়ে ২৭ বছরেও ফেরেনি শান্তি, বেড়েছে দ্বন্দ্ব-সংঘাত

৩ সপ্তাহ আগে
শান্তিচুক্তির ২৭ বছরেও শান্তি ফেরেনি পার্বত্য অঞ্চলে। বরং নতুন নতুন দলের আবির্ভাবে বেড়েছে দ্বন্দ্ব সংঘাত। সংঘাত ও বিভক্তি দূর করতে আঞ্চলিক দলগুলো শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবি করলেও সাংঘর্ষিক ধারাগুলো বাতিলের দাবি বাঙালি সংগঠনগুলোর। আধিপত্য বিস্তার, গুম-খুন, চাঁদাবাজি ও ভাতৃঘাতি সংঘাতে আজো উত্তাল পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি।

শান্তিচুক্তিকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে পক্ষ বিপক্ষ। একপক্ষ বলছে চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে শান্তি ফিরবে আরেক পক্ষের দাবি শান্তি চুক্তি সাংঘর্ষিক। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য পাহাড়ের বাসিন্দাদের। 


এতদিনেও চুক্তি পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন না করায় সর্বত্র হতাশা তৈরি হয়েছে। বারবার পাহাড়ি-বাঙালি বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত শান্তির দেখা মিলছে না পাহাড়ে। ৫ আগস্ট পরবর্তী পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পার্বত্য চুক্তির মৌলিক ধারাসমূহ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে আশাবাদী সাধারণ পাহাড়িরা। 


তবে পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৭ বছর পার হলেও পাহাড়ে এখনও বন্ধ হয়নি অস্ত্রের ঝনঝনানি। পাহাড়ি তিন জেলায় সশস্ত্র ৬টি সংগঠনের আধিপত্যের লড়াইয়ে নিহত হয়েছে হাজারেরও বেশি মানুষ। আহত ও উদ্বাস্তু হয়েছে আরও অনেকে। গত ৩ মাসে শুধু খাগড়াছড়ি জেলায় আধিপত্যের লড়াইয়ে নিহত হয়েছে ৬ জন। এর মধ্যে পানছড়ি উপজেলায় ৪ জন ও দীঘিনালায় ২ জন। অবৈধ অস্ত্র ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পাহাড়ের উন্নয়ন ও শান্তির ধারা। এসব অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের হস্তক্ষেপ চান সাধারণ মানুষ। 


এদিকে চুক্তির বর্ষপূর্তিতে এবার খাগড়াছড়িতে সরকারিভাবে কোন কর্মসূচি নেই। তবে জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) ২ ডিসেম্বর শোভাযাত্রাসহ আলোচনা সভার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।


উত্তাল পাহাড়ি জনপদে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে জনসংহতি সমিতি জেএসএস এর সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে আওয়ামী লীগ সরকার। ২রা ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে অস্ত্র জমা দিয়ে সুপথে ফিরে আসে সন্তু বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্য। শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া পার্বত্যাঞ্চলে শুরু হয় ব্যাপক উন্নয়নের কাজ। গেল দুই যুগে শিক্ষা স্বাস্থ্য যোগাযোগসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে হয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন।


পার্বত্যাঞ্চলকে সুরক্ষিত করতে ও কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়নের লক্ষ্যে দুর্গম সীমান্ত এলাকায় নির্মিত হচ্ছে সীমান্ত সড়ক। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক ভাবেও স্বাবলম্বী হয়েছে পাহাড়ের মানুষ। এছাড়াও পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের জীবনমানে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। কিন্তু চুক্তির ২৭ বছরেও কাঙ্ক্ষিত শান্তি ফিরে আসেনি পাহাড়ি এ জনপদে। আধিপত্য বিস্তারের জেরে সৃষ্ঠি হয়েছে নতুন নতুন দল।


আরও পড়ুন: পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৬তম বর্ষপূর্তি, খাগড়াছড়িতে রোড শো


মূলতঃ শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর, ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে অস্ত্র সমর্পণ করে তৎকালীন শান্তি বাহিনীর সদস্যরা। তবে চুক্তির বিরোধিতা করে একই বছরের ২৬ ডিসেম্বর আত্মপ্রকাশ করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এরপর থেকে পাহাড়ে আবারও অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। গেল ২৭ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ ভেঙে হয়েছে ৪টি সশস্ত্র সংগঠন। এ ছাড়া বান্দরবানে কুকি চীন ও মগ পার্টি নামে আরও ২টি সশস্ত্র  সংগঠনের জন্ম হয়েছে। 


এসব দলের সদস্যরা লিপ্ত হচ্ছে চাঁদাবাজি, গুম, খুন ও রক্তক্ষয়ী সংঘাতে। ফলে পার্বত্য ৩ জেলায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদা ও অপহরণ নিয়ে থেমে থেমে হচ্ছে প্রাণহানি। 


এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৬ সশস্ত্র সংগঠনের চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদা ভাগবাটোয়ারা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর এ পর্যন্ত সহস্রাধিক মানুষ খুন হয় এবং এক হাজার ৫০০ গুম হয়েছে। খুনের মধ্যে সামরিক বাহিনীর সদস্য ও সরকারী কর্মকর্তাও রয়েছে।


মূলত: কাপ্তাই বাঁধ তৈরির ফলে উদ্বাস্তু মানুষগুলোর হতাশার ফলে ১৯৭৩ সালে পাহাড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সৃষ্টি হয় এবং ৭৫ পরবর্তীতে শান্তিবাহিনী সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। এতে প্রায় দুই যুগের বেশি সময় ধরে চলে সশস্ত্র সংগ্রাম। এতে অসংখ্য পাহাড়ি ও বাঙালি ক্ষতির শিকার হন। পাহাড়ের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও শান্তি প্রক্রিয়া পিছিয়ে পড়ে।


এখানে উল্লেখ্য যে, চুক্তির স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের ১০ ফ্রেরুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর হাতে গেরিলা নেতা সন্তু লারমার অস্ত্র সমর্পণের মধ্য দিয়ে জনসংহতি সমিতির সদস্যরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। কিন্তু চুক্তির পর একে একে পাহাড়িদের ৬টি সশস্ত্র সংগঠন জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (এমএন লারমা), ইউপিডিএফ (প্রসীত), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি) ও কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-এর এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের লড়াই চলছে। ৬ সশস্ত্র সংগঠনের সহিংসতা মাঝে-মধ্যে পাহাড়ের সম্প্রতির ওপরও আঘাত হানছে। সাধারণ মানুষ চান পাহাড়ে উন্নয়নের গতি বাড়াতে, চাঁদাবাজি  বন্ধ ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার।


নিরাপত্তাবাহিনীর একটি সূত্র জানায়, পাহাড়ে শান্তি চুক্তির পর ১৯৯৮ সালে চুক্তিবিরোধী যে সংগঠনের জন্ম হয় সে সশস্র সংগঠনটির হাতে ১৮৫ জন জেএসএস কর্মীসহ দুই শতাধিক লোক নিহত ও এক শতাধিক অপহৃত হয়েছে। অনুরূপভাবে জেএসএস এর হাতে প্রায় একই সংখ্যক ইউপিডিএফ কর্মী নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।


নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্রটি আরও জানায়, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পাহাড়ের ৪ সংগঠনের কাছে এসেছে ৫ শতাধিক আধুনিক মরণাস্ত্র। এ সব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে এলএমজি, এসএমজি, একে৪৭ রাইফেল, ৭.৬২ মি.মি. রাইফেল, এম-১৬ রাইফেল, জি-৩ রাইফেল, ০.২২ রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, পিস্তল, মর্টার, দেশীয় পিস্তল, দেশীয় বন্দুক, হ্যান্ড গ্রেনেড ও রকেট লাউঞ্চারসহ আধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র।


পাহাড়ের ভৌগলিক অবস্থানকে পুঁজি করে দুর্গম এলাকায় ক্যাম্প গড়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের যোগান বাড়াচ্ছে এসব সংগঠন। পাহাড়ে সন্ত্রাসীরা নিজেদের প্রয়োজনে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করছে বলে স্বীকার করলেও নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে একে অপরের দিকে অভিযোগ ছুড়ছে সংগঠনগুলো।


পাহাড়ের এই হানাহানির পেছনে রয়েছে মূলত: এলাকায় তাদের নিজ নিজ আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদা আদায় করা। পাহাড়ে পুলিশের অবস্থান কম থাকায় চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম সমতলের চেয়ে অনেক বেশি। এখানে প্রচুর চাঁদাবাজ থাকলেও এই পর্যন্ত কোন চাঁদাবাজের শাস্তি হয়নি। ফলে এখানে হানাহানি লেগেই রয়েছে। এই অবস্থার উত্তরণ হওয়া একান্ত প্রয়োজন বলে এলাকার সচেতন মহল মনে করছে।


স্থানীয় সূত্রে আরও জানা যায়, প্রতিবার সংঘর্ষের সময় পাহাড়ের বিবাদমান সশস্র সংগঠনগুলো ব্যবহার করছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। বন্ধুক যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তারা শত শত রাউন্ড গুলি ব্যবহার করছে। কিন্তু সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই দুই গ্রুপের কাছ থেকে কোন অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি। ফলে দিন যতই যাচ্ছে লোকজনের মধ্যে ততই আতঙ্ক ততই বাড়ছে।


আরও পড়ুন: রাঙ্গামাটিতে শান্তি চুক্তির ২৬ বছর পূর্তি উদযাপন


ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি সন্তোষিত চাকমা বকুল বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সদিচ্ছার অভাবে চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন প্রলম্বিত হয়েছে। চুক্তির সব ধারা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ভূমি বিরোধসহ সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটছে বলে অভিমত তাদের। নতুন সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা অনুধাবন করে ভূমি সংকট নিরসন, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসনসহ চুক্তির পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে পার্বত্য চুক্তি ও আদিবাসী শব্দ অন্তর্ভুক্তির আহ্বান জানান।


পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এমএন লারমার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুর্দশন চাকমা বলেন, চুক্তির ২৭ বছরেও বহু ধারা উপধারা আজো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। তারপরও তিনি আশা করেন, সহসাই পার্বত্য এলাকার হানাহানি বন্ধ হবে ও ফিরে আসবে শান্তি, নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এই প্রত্যাশা পাহাড়ের মানুষের।


পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদ বলেন, পার্বত্য চুক্তিতে
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘাত ও বিভক্তি সৃষ্টি করেছে। পাহাড়ে নতুন নতুন সৃষ্টি হওয়া আঞ্চলিক দলগুলো হত্যা, গুম ও চাঁদাবাজি লিপ্ত থাকে। তাই পাহাড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারসহ পার্বত্য চুক্তির সাংঘর্ষিক ধারাগুলো বাতিলের দাবি জানান।


তিনি আরও বলেন, এই চুক্তিতে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে। তাই বৈষম্যমূলক এ চুক্তি বাতিল করে পাহাড়ে সমাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।


খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান জানান, পাহাড়ে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে এবং সন্ত্রাসীরা যাতে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সে বিষয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন