অথচ আজকের মুসলিম সমাজে এই ভ্রাতৃত্ববোধ বিলুপ্তপ্রায়। ফলে সমাজে বিভক্তি, হিংসা, হানাহানি এবং একে অপরকে হেয় করার মতো অনৈক্য দেখা দিয়েছে।
বিশেষ করে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে হৃদ্যতা নেই। আজ আমাদের সমাজে আত্মীয় হোক বা প্রতিবেশী, কেউ কষ্টে পড়লে, দুঃখে ভোগলে, রোগে আক্রান্ত হলে, বা আর্থিক সংকটে পড়লে অধিকাংশ মানুষ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কেউই আন্তরিকভাবে পাশে দাঁড়াতে চায় না, সাহায্যের হাত বাড়ায় না। অথচ ইসলাম আমাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি করা শেখায়।
আরো পড়ুন: কিস্তিতে ক্রয়-বিক্রয় করা কি বৈধ?
আল্লাহ তাআলা বলেন,
নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পরের ভাই। সুতরাং তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমাদের প্রতি দয়া করা হয়। (সুরা হুজুরাত: ১০)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের এক দেহের মতো ভাই ভাই বানিয়েছেন। এটা কোনো জাতি, গোত্র বা রক্তের ভিত্তিতে নয়; বরং ইমানের ভিত্তিতে সৃষ্টি হওয়া ভ্রাতৃত্ব।
ভ্রাতৃত্ব রক্ষা করলে আল্লাহর রহমত নেমে আসে
তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। (সুরা আল ইমরান: ১০৩) আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিচ্ছেন একত্রিত থাকতে, বিভক্ত না হতে, এই একতা ও ভ্রাতৃত্বই মুসলিম সমাজের শক্তি।
রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِي تَوَادِّهِمْ وَتَرَاحُمِهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ، كَمَثَلِ الْجَسَدِ মুমিনদের পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়া ও সহানুভূতির দৃষ্টান্ত এক দেহের মতো; দেহের এক অঙ্গ ব্যথিত হলে পুরো দেহ নিদ্রাহীন ও জ্বরাক্রান্ত হয়ে পড়ে।(সহিহ মুসলিম: ২৫৮৬) মুসলিম সমাজ একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল না হলে সেটা জীবিত সমাজ নয়, বরং একটি অসাড় কাঠামো।
সহানুভূতির অভাব ইমানের দুর্বলতা
لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা চায়, ভাইয়ের জন্যও তা না চায়। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
অসহায়দের সাহায্য না করা জাহান্নামের কারণ হতে পারে
وَلَا يَحُضُّ عَلَىٰ طَعَامِ ٱلْمِسْكِينِ সে মিসকিনদের খাদ্য দেয়ার উৎসাহ দেয় না। (সুরা মাউন: ৩) দুঃখী ও দরিদ্রদের সাহায্য না করা এত বড় গুনাহ যে আল্লাহ এই কারণেই শাস্তি দিবেন।
মানবিক সহযোগিতা ইমানের প্রমাণ
وَيُؤْثِرُونَ عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ তারা নিজেদের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও অন্যদেরকে অগ্রাধিকার দেয়। (সুরা হাশর: ৯) প্রকৃত মুমিন সে, যে নিজে অভাবী হলেও ভাইয়ের কষ্টে সাহায্য করে।
মুমিনের দুঃখ দূর করা মানে নিজের দুঃখ দূর হওয়া
من نفس عن مؤمن كربة من كرب الدنيا نفس الله عنه كربة من كرب يوم القيامة যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোনো মুমিনের কষ্ট দূর করে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার কষ্ট দূর করে দেবেন।(সহিহ মুসলিম: ২৬৯৯)
ভ্রাতৃত্বের অভাবে সমাজে যা হচ্ছে
১. সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা, আত্মীয়স্বজন পরস্পরের খবর নেয় না। ২. সহানুভূতির অভাব, কেউ বিপদে পড়লে পাশে দাঁড়ানোর মানুষ নেই। ৩. বিভেদ ও দলাদলি, উম্মাহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন। ৪. মুমিনের পরিচয় হারিয়ে যাওয়া, একজন আরেকজনকে শত্রু মনে করে
৫.মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে, শুধু নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত।
আরো পড়ুন: সুদের শাস্তির ভয়াবহতা নিয়ে যা বলেছেন নবীজি
৬. সহানুভূতির মৃত্যু ঘটেছে, অন্যের দুঃখে নিজে ব্যথিত হই না। ৭. আখেরাতের ভয় নেই, সাহায্য করলে পরকালের প্রতিদান ভুলে গেছি। ৮. প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে, সহযোগিতা নয়, হিংসা ও উপেক্ষা ছড়িয়েছে। আজকের সমাজে এসব রোগই মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে, হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার ও সম্পর্কচ্ছেদ।
সমাজে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার করণীয়
ভ্রাতৃত্ব বিনষ্টকারী কাজগুলো নিষিদ্ধ করা। لَا تَبَاغَضُوا، وَلَا تَحَاسَدُوا، وَلَا تَدَابَرُوا، وَكُونُوا عِبَادَ اللَّهِ إِخْوَانًا তোমরা একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ কোরো না, হিংসা কোরো না, সম্পর্ক ছিন্ন কোরো না, তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে যাও। (সহিহ মুসলিম: ২৫৬৩)
১. তাকওয়া অর্জন করা। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাতে রহমতপ্রাপ্ত হও। (সুরা হুজুরাত: ১০) ২. সহানুভূতিশীল হওয়া ও দুঃখ ভাগাভাগি করা। রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ ছিল, সবচেয়ে দুর্বল মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
৩. হাসিমুখে কথা বলা, কষ্ট দূর করা। ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলাও সদকা। (তিরমিজি: ১৯৫৬)
৪. দ্বীন শিখে তা সমাজে প্রয়োগ করা। দ্বীনি শিক্ষা ছাড়া সত্যিকারের ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় না। ৫. বিতর্ক ও অহংকার পরিহার করা
কারণ এসব ভ্রাতৃত্বের প্রধান শত্রু।
আমাদের সমাজে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী এমনকি মুসলিম ভাইয়ের খবরও কেউ রাখে না। অথচ ইসলাম ইমানের ভিত্তিতে একটি হৃদয়বান, সহানুভূতিশীল ও সহমর্মী সমাজ গঠনের আদর্শ দিয়েছে। আমরা যদি কুরআন-হাদিসের শিক্ষা অনুসরণ করি, তাকওয়া অর্জন করি এবং অন্য ভাইয়ের দুঃখ নিজের মনে দুঃখ মনে করি, তবেই আমাদের সমাজে আবার ফিরে আসবে শান্তি, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব।
]]>