পদ্মার সেই সুস্বাদু ইলিশ হারিয়ে গেল কোথায়?

৩ দিন আগে
স্বাদ আর গন্ধের কারণেই ইলিশের বেশ কদর। একসময় বাদলভরা বর্ষার দিনে বাঙালির ঘরে ঘরে ইলিশ রান্নার গন্ধে ভরে উঠতো। কিন্তু এখন সেই চিত্র বিরল! বাজারে ইলিশ যাও পাওয়া যায় তার মধ্যে স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় পদ্মার ইলিশ তাকে না বললেই চলে।

চলছে ভরা বর্ষা, ইলিশের মৌসুম। দক্ষিণের সাগরে ইলিশের দেখা মিললেও পদ্মা ও মেঘনাসহ ইলিশের বাড়ি হিসেবে পরিচিত নদ-নদীগুলোতে আগের মতো দেখা মেলে না ইলিশের।


পরিভ্রমণশীল ইলিশ বিচিত্র স্বভাবের মাছ। তাদের মূল আবাস সাগর হলেও কখনো কখনো নোনাপানি তাদের অসহ্য লাগে। তাই তো ছুটে আসে উজানের মিঠা পানির খোঁজে। দক্ষিণের সাগর মোহনায় যেখানে নোনা পানির সঙ্গে মেঘনার মিঠা পানি মিতালি গড়ে সেদিকে পাড়ি দেয় শত শত মাইল। মোহনা পেরিয়ে পদ্মা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে ইলিশের ঝাঁক। এসময় যৌবনে ফিরে যায় ইলিশ। আকার পরিবর্তনের সঙ্গে স্বাদ-গন্ধেও মাদকতা ছড়ায়। আর তাই সাগরের ইলিশের চেয়ে পদ্মা-মেঘনার ইলিশের চাহিদা অনেক বেশি। বছরজুড়ে এমনটা কমবেশি দেখা গেলেও প্রতিবছর ভরা বর্ষায় নতুন প্রাণ পায়। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে উজানের পানির তীব্র চাপ- এর মাঝে সাগর থেকে উল্টো পথে নদীর দিকে ছুটে আসে ইলিশ।


কিন্তু এখন আর পদ্মা-মেঘনার মিঠা পানির ছোঁয়া পাবার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় খুব কম ইলিশের। ফলে বাঙালির পাতেও পদ্মার ইলিশ এখন ওঠে না বললেই চলে? কিন্তু এর কারণটা কী?

 

সাগরের ইলিশ নদীতে উঠতেই পারছে না

 

সমুদ্র নিকটবর্তী জেলা ঝালকাঠি। সেখানকার বিষখালী নদী ইলিশ আহরণের প্রধান ক্ষেত্র। উপজেলার ইলিশ বাজারগুলোতে ক্রেতা থাকলেও নেই মাছ। মাঝেমধ্যে দুই একজন জেলের জালে দুয়েকটি মাছ ধরা পড়লেও বাজারে তার দাম আকাশ ছোঁয়া।


সেন্টু নামে এক জেলে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরেই আস্তে আস্তে নদীতে মাছ কমে গেছে। তবে এবারের মতো অবস্থা আগে কখনও হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে মাছ ধরা ছেড়ে চায়ের দোকান দিয়ে বসেছি।’

 

 সময় সংবাদভরা মৌসুমে বিষখালি নদীতে নেই ইলিশের দেখা। হতাশায় নৌকায় শুয়ে আছেন জেলে। ছবি: সময় সংবাদ


চাঁদপুর সদরের হরিণা ঘাটের জলিল গাজীর (৬৫) শৈশব থেকে নদী-জাল-নৌকার সঙ্গে মিতালি। তিনি জানালেন, ৫-৭ বছর আগেও বর্ষায় নদীতে ইলিশের কমতি ছিল না। মেঘনায় জাল ফেললেই বিভিন্ন সাইজের ইলিশ ধরা পড়তো। নিজের দুই ছেলেসহ অন্য জেলেদের সঙ্গে এখনো নদীতে যান জলিল গাজী। কিন্তু ইলিশের আকাল তাকে হতাশ করে। এখন এটাকে তিনি ‘নিয়তি’ হিসেবেই মেনে নিয়েছেন।


চাঁদপুর বড়স্টেশন পাইকারি মাছ বাজারের ব্যবসায়ী সুমন খান একসময় মামার সঙ্গে ব্যবসা করতেন। এখন নিজেই আলাদাভাবে ব্যবসা করেন। জানালেন, মৌসুমের এই সময় প্রতিদিন বড়স্টেশনে আড়াই থেকে তিন হাজার মণ ইলিশ বেচাকেনা হতো। তবে গত ২-৩ বছর ধরে সেই চিত্র নেই। এখন বিক্রি নেমে এসেছে ২-৩ শো মণে। প্রতিদিন একই রকম হয় না। আমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমার ওপর নির্ভর করে ইলিশের সরবরাহ বাড়ে। এর মধ্যে পদ্মা-মেঘনার ইলিশের পরিমাণ খুবই কম।

 

ইলিশের নাগাল পেতে দক্ষিণের সাগর মোহনায় হাজার হাজার জাল ফেলেন জেলেরা। নানা প্রকারের সেই জালে ইলিশের ঝাঁক ধরা পড়ে অথবা বাধা পায়। এরমধ্যে অসংখ্য সর্বনাশা নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল, মশারি ও ফাঁস জালও থাকে। এতশত বাঁধা পেরিয়ে আগের মতো ইলিশের ঝাঁক পৌঁছাতে পারে না চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনায়। তারপরেও নদীতে যে মাছগুলো পাওয়া সেগুলো মূলত দলছুট হয়ে ফাঁকফোকর দিয়ে চলে আসা; যার পরিমাণ খুবই সামান্য।


সম্রাট বেপারী নামে চাঁদপুরের আরেক মাছ ব্যবসায়ী জানান, স্বাদ আর গন্ধের জন্য বাজারে চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনার ইলিশের চাহিদা বেশি। কিন্তু কম ধরা পড়ার কারণে তার দামও বেশি।


রাজধানীসহ দেশর অন্যান্য জায়গায় তো বটেই ইলিশের বাড়ি চাঁদপুরেও পদ্মা-মেঘনার ইলিশ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। আকাশছোঁয়া দাম নিয়ন্ত্রণে গত ১৭ জুন চাঁদপুর জেলা প্রশাসন গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে ‘চাঁদপুর ইলিশের বাড়ি’ পরিচিতি টিকিয়ে রেখে ইলিশের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণের কথা বলা হয়। জেলা প্রশাসক জানান, বর্তমানে ইলিশের মৌসুম চললেও বাজারের দামে তার প্রভাব নেই।


চাঁদপুরের মতো একই চিত্র দেশের অন্যান্য নদীগুলোতেও। লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীতে সারাদিন নদীতে জাল ফেলেও শূন্য হাতে ফিরতে হচ্ছে জেলেদের। ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর জেলারাও হতাশ।


লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের মতিরহাট এলাকার জেলে রুবেল বলেন, ‘নদীতে আগে প্রচুর ইলিশ পড়ত, এখন দিনে একেকবার নদীতে যেতে খরচ হয় ৪-৫ হাজার টাকা, অথচ মাছ বিক্রি করে পাই মাত্র দেড় থেকে দুই হাজার টাকা।’

 

 সময় সংবাদকাঙ্ক্ষিত ইলিশ না পেয়ে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর জেলেদের। ছবি: সময় সংবাদ


মতিরহাট মাছ ঘাটের সভাপতি আবদুল খালেক মেম্বার বলেন, ‘নাব্য সংকটের কারণে ভরা মৌসুমেও এখন মেঘনায় ইলিশ নেই। ঘাটে নেই আগের মতো হাঁকডাক। নদীর নাব্য না ফিরালে ভবিষ্যতে আর ইলিশের দেখা মিলবে না। এখনকার অবস্থা খুবই করুণ।’
 

লক্ষীপুর জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্মীপুরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ২৩ হাজার টন। ২৫টি মাছ ঘাটে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে তিন টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছে। তবে স্থানীয় জেলে ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মৎস্য বিভাগ প্রকৃত চিত্র আড়াল করছে। তারা বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে সঠিক তথ্য কেউ নিচ্ছে না।’

 

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?

 

চাঁদপুরসহ দেশের নদনদীতে ইলিশের সঙ্কট নিয়ে কথা হয় বিশিষ্ট মৎস্যবিজ্ঞানী ও ইলিশ গবেষক ড. মোহাম্মদ আনিছুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‌‘ঝাঁক বেঁধে ছুটে চলা ইলিশ মাছ কোথাও বাধা পেলে উল্টো পথে ফিরে যায়। বর্তমানে সাগর মোহনা থেকে শুরু করে মেঘনার বিভিন্ন পয়েন্টে চর, ডুবোচরে ভরে গেছে। তার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তো আছেই।’


নদী দূষণ নিয়ে তিনি আরেকটি ভয়ংকর তথ্য দেন, তা হচ্ছে ‘মাইক্রো প্লাস্টিক’। এটি এখন জলজ প্রাণীর জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদ-নদীতে ইলিশ সংকটের এটিও একটি কারণ।


ড. মোহাম্মদ আনিছুর রহমান বলেন, ‘জেলেরা যেসব জাল দিয়ে মাছ শিকার করেন। তা ব্যবহারে নিয়মনীতি মানাতে হবে। জাটকা, পোনা, রেণু ধ্বংস করে- এমন জাল নিষিদ্ধ করে আইনের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। তার সঙ্গে নদীগুলোকে দূষণ থেকে রক্ষা করতে সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।’

 

আরও পড়ুন: ইলিশের মূল্য নির্ধারণের প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন


ইলিশ মাছের উৎপাদন বাড়াতে প্রতিবছর মার্চ-এপ্রিল এই দুই মাস জাটকা সংরক্ষণ কর্মসূচি পালন করা হয়। একই সঙ্গে ইলিশের ডিম ছাড়ার প্রক্রিয়া নির্বিঘ্ন করতে প্রজনন মৌসুম অর্থাৎ অক্টোবরের ২৫ দিন অভয়াশ্রমগুলোতে সব ধরণের মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। এতে কিছুটা হলেও ইলিশ উৎপাদনে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

 

লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘সমুদ্রে ইলিশ ধরা পড়লেও জলবায়ু পরিবর্তন, নদীর নাব্য সংকট এবং বৃষ্টিপাতের ঘাটতির কারণে মেঘনায় ইলিশ মিলছে না। তবে বৃষ্টিপাত হলে আগামী মাসের (আগস্টে) শেষের দিকে ইলিশ ধরা পড়বে বলে আশা করা যায়।’

 

ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেবও প্রায় একইরকম তথ্য দিলেন। তিনি বলেন, মোহনায় ইলিশের চলাচলের চ্যানেলগুলো চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় মাছ কমে গেছে। তবে পানির গভীরতা বাড়লে ইলিশের দেখা মিলবে।

 

ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাহিদা আক্তারের মতে, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে এখন নদীতে মাছ কম হলেও অমাবশ্যার সময় ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন