তিস্তা গিলছে শেষ সম্বল বসতভিটা-ফসলি জমি

২ সপ্তাহ আগে
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় তিস্তার তাণ্ডব আবারও হানা দিয়েছে। প্রবল বর্ষণের পর হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠা নদী গ্রাস করছে মানুষের বসতভিটা, ফসলি জমি আর বহু দিনের লালিত স্বপ্ন। পূর্ব দুহলপাড়া ও পূর্ব বাইশপুকুর গ্রামের বিস্তীর্ণ জনপদজুড়ে এখন শুধুই আতঙ্ক। প্রতিদিন নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি, আবাদি জমি আর জীবনের সঞ্চয়। বছর বছর এমন দুর্দশা হলেও আজও গড়ে ওঠেনি কোনো কার্যকর ও স্থায়ী প্রতিরোধ ব্যবস্থা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গত এক সপ্তাহের টানা ভারি বর্ষণে তিস্তার পানির হঠাৎ বৃদ্ধির ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে তীব্র ভাঙন। ডিমলার খগাখড়িবাড়ী ও খালিশা চাপানি ইউনিয়নের অন্তর্গত পূর্ব দুহলপাড়া ও পূর্ব বাইশপুকুর গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ এখন ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। কোথাও ঘরবাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে, কোথাও আবার বসতবাড়ি থেকে মাত্র ২০০ থেকে ২৫০ মিটার দূরে পৌঁছে গেছে ভাঙন।


ভাঙনের তীব্রতা সম্পর্কে স্থানীয়রা জানান, কোনো রকম ‘স্পার’ বা ‘গ্রোয়েন বাঁধ’ না থাকায় এই ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রতি বছর কোটি টাকার সম্পদ তিস্তা কেড়ে নিলেও এখনো নেই কোনো স্থায়ী বাঁধ প্রকল্প।


পূর্ব দুহলপাড়ার আশিনুর আখি বলেন, ‘ইন্টার পাশ করে বিয়ে হওয়ার সময় শ্বশুরের ১১ বিঘা জমি ছিল। একে একে সব নদীতে গেছে। এখন আধা বিঘা বসতভিটার ওপর দাঁড়িয়ে আছি। এটুকুও যদি যায়, তাহলে আমরা রাস্তায় দাঁড়াব কোথায়?’


স্থানীয় বাসিন্দা রুহুল আমিন বলেন, ‘আর দুহাত ভাঙলেই বাড়িটা নদীতে চলে যাবে। এক সপ্তাহ আগে ছাগলের খামার গেল, এখন গরুর খামার যাওয়ার পথে। বাঁচব কিভাবে?’


দক্ষিণ খড়িবাড়ী গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত তিস্তা পাড়ের গৃহবধু লাইলী বেগম বলেন, ‘আমাদের জমি জায়গা সব গেছে নদীতে । ১২ বিঘা জমিতে আমন করেছি সেটাও শেষ। এখন চাষাবাদ করে খাওয়ার মতো কনো কিছুই নাই।’
 

তিস্তায় ক্ষতিগ্রস্ত একই গ্রামের কৃষক আয়নাল হক বলেন, ‘ডিমলায় তিস্তা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার বিঘা আবাদী জমি ও ঘরবাড়ি। প্রতিদিন নদীগর্ভে আবাদি জমি ও ঘরবাড়ী বিলীনের আশঙ্কায় ভাঙন আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে নদীপাড়ের মানুষ।’


আরও পড়ুন: তলিয়ে গেছে হাতিয়া, ভাঙনে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন অনেকে


দক্ষিণ খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার বজলার রহমান বলেন, ‘ইতোমধ্যে বহু বসতবাড়ি ও আবাদি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। দিনে দিনে বিপর্যয় বেড়েই চলেছে।’


খালিশা চাপানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সহিদুজ্জামান বলেন, ‘আমার এলাকায় দুটি মৌজায় ভাঙন শুরু হয়েছে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড এখনও কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ নিঃস্ব হয়ে রাস্তায় বসবে।’


ডালিয়া পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আমিতাভ চৌধুরী দাবি করেন, বেশ কিছু ভাঙন প্রবণ এলাকায় কাজ করেছি। এবার ভাঙন প্রবণতা কিছুটা কম। ৩ থেকে ৪টি পয়েন্টে পূর্ব সতর্কতামূলক কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। হঠাৎ ভাঙন শুরু হলে তা মোকাবেলায় প্রস্তুতি রয়েছে।


তিস্তার পাড়ের মানুষদের জন্য বর্ষা মানেই দুশ্চিন্তা আর আতঙ্ক। প্রতিবছর একই দৃশ্য, একই কান্না, অথচ একইরকম উদাসীনতা। বসতভিটা হারানোর বেদনা আর প্রশাসনের প্রতিশ্রুতির ফাঁকা শব্দের মাঝেই অস্তিত্বের লড়াইয়ে লিপ্ত এই জনপদের মানুষ। যতদিন না গৃহীত হবে স্থায়ী বাঁধ প্রকল্প, ততদিন পর্যন্ত তিস্তার এই গ্রাস থামবে না, আর থামবে না মানুষ হারানোর হাহাকারও।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন