তিনি দিনে পুলিশ, রাতে বালু লুটপাট চক্রের ‘ত্রাণকর্তা’

৩ সপ্তাহ আগে
দিনে পুলিশের পোশাক পরলেও রাতে কখনই তাকে সরকারি এ পোশাকে দেখা যায় না। সাদা পোশাকে রাত গভীর হলেই তিনি দেখা দেন অন্ধকার নদীপথে। তার দেখা শুধু তারাই পান যারা অধীর আগ্রহে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীতে বালু বোঝাই নৌকা নিয়ে অন্ধকারে অপেক্ষা করেন। অনেকটা সাধনা করার মতোই, তাকে পাওয়া।

অন্ধকারে সাদা পোশাকে থাকা পুলিশের এই কর্মকর্তাকে অনেকটা আকাশ থেকে নদীতে নেমে আসা ‘ফেরেশতার’ মতোই দেখেন অবৈধপথে লুটপাটে সুবিধা নেয়া চক্রের সদস্যরা। 


নদীর দুই তীরের গ্রামবাসীদের মতে, এই ‘ফেরেশতার’ আবার হৃদয়ে দয়া অনেক। সরকারের মন্ত্রণালয় ও আদালতের নির্দেশে বন্ধ থাকা নদী থেকে বালু-পাথর উত্তোলন করতে তিনি তার কাছে সাধনা করে আসা মানুষদের ফিরিয়ে দিতে পারেন না। তবে এক্ষেত্রে ‘ফেরেশতা’ হলেও তিনি নেন নির্ধারিত অঙ্কের হাদিয়া। এ হাদিয়া দেয়া নৌকাগুলোই রাতের অন্ধকারে ধোপাজান নদী থেকে বালু বোঝাই করে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারে বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।

যেভাবে ধোপাজানে লুটপাট:

দীর্ঘদিন ধরেই সুনামগঞ্জের ধোপাজান নদী অপরাধের স্বর্গরাজ্য হিসেবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ব্যাপকভাবে যান্ত্রিক সহযোগিতা নিয়ে লাখ লাখ ঘনফুট পাথর ও বালু উত্তোলন করায় নদীর দুই তীরের গ্রামের পর গ্রাম ভাঙনের মুখে পরে পরিবেশ বিপন্ন হওয়ায় ২০১৮ সালে ধোপাজান নদীতে সব ধরনের বালু পাথর উত্তোলন বন্ধ করে দিয়েছিল খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। একের পর এক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে নদীতে চলা শত শত অবৈধ বোমা মেশিন ধ্বংস করা হয়। এরপর বেশ কিছুদিন এসব অপকর্ম বন্ধ থাকার পর ২০২৪ সালে সরকার পতনের আন্দোলনের পর ৫ আগস্ট পরবর্তী সময় থেকে আবারও টানা ২ মাসের বেশি সময় ধরে লুটপাট চলতে থাকলে কোটিপতি বনে যান একটি প্রভাবশালী চক্রের সদস্যরা। এ চক্রে কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তা, কিছু সাংবাদিক নামধারি, বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ব্যক্তি সম্মিলিতভাবে অপরাধে মিলিত হন।
 

সময় সংবাদের অনুসন্ধান:


আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ৭ আগস্ট থেকে সুনামগঞ্জের ধোপাজান নদীতে প্রকাশ্যে ব্যাপক লুটপাট চলতে থাকলে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজারের বেশি বাল্কহেড নৌযান বোঝাই করে বালু পাথর নিয়ে যায় চক্রের সদস্যরা। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ভঙ্গ করে ও প্রশাসনের আদেশ অমান্য করে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫ কোটি টাকার বালু অবৈধভাবে নদী পথে পরিবহন শুরু হলে চক্রটির ব্যাপারে অনুসন্ধানে নামে সময় সংবাদ। চাঞ্চল্যকর তথ্য তুলে ধরার পাশাপাশি নৌযান থেকে চাঁদা আদায় করে কথিত ‘লাইন ক্লিয়ার’ দেয়ার সময় হাতেনাতে পুলিশের কিছু সদস্যদের ধরে ফেলতে সক্ষম হয় সময় সংবাদ। 

আরও পড়ুন: সিলেটাঞ্চলের রেলপথে বাঁকে বাঁকে ‘মৃত্যুফাঁদ’

এরপর সংবাদটি প্রচারের পর পুলিশ সদর দপ্তরের তাৎক্ষণিক নির্দেশনা ও তদন্তে সদর মডেল থানার ওসি নাজমুল হক, তদন্ত ওসি ওয়ালী আশরাফ, এসআই রাব্বী ও ডিবি ওসিসহ কমপক্ষে ১২ পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যকে বদলির পাশাপাশি অনেকের বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় ধোপাজান নদীর প্রবেশ মুখও। সংবাদের একটি অংশে স্থানীয় জেলা প্রশাসকও পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে প্রভাবশালী চক্রের বিপরিতে কাজ করে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরলে সুনামগঞ্জ পরিদর্শন করেন সিলেটের তৎকালীণ বিভাগীয় কমিশনার। মতবিনিময় সভায় তৎকালীন পুলিশ সুপার আ ফ ম আনোয়ার হোসেন খান উপস্থিত থাকায় ছাত্র জনতা ও সাধারণ মানুষের তোপের মুখে পড়তে হয় পুলিশ সুপারকেও। তবে ঘটনাচক্রে কিছুদিন পর বিস্তর দুর্নীতি অনিয়মের সংবাদ গণমাধ্যমে প্রচার হলে তাকেও সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় পুলিশ সদর দপ্তর।


আবারও জহির যেভাবে চালাচ্ছেন ধোপাজান:

দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া পুলিশ সদস্যদের ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরের শক্ত অবস্থানের মাঝেও রাতের আধাঁরে আবারও সুনামগঞ্জের আলোচিত এই ধোপাজান নদী থেকে লুট করা বালু বোঝাই নৌকা বের করার বিস্তর অভিযোগ উঠেছে সদর মডেল থানার এসআই (সেকেন্ড অফিসার) জহিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। আর এ কাজে তিনি রাত গভীর হলে (রাত ৩টা থেকে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত সময়ে) কৌশল অবলম্বন করতে গিয়ে পুলিশের পোশাকের পরিবর্তে নৌকা নিয়ে একাই চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে নদীর মনিপুরী ঘাট পয়েন্টসহ কয়েকটি পয়েন্টে নিয়মিত যাতায়াতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু যাতায়াত নয়, সুযোগ বুঝে রাতের অন্ধকারে ধোপাজান নদীর বালু মহাল থেকে নৌকা বোঝাই করে বালু লুট করতে প্রতি নৌকা থেকে ৫ থেকে ১০ হাজার করে টাকাও আদায় করানোর অভিযোগ উঠেছে পুলিশের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তবে এই টাকা উত্তোলনে এসআই জহিরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ ৪ জন ব্যক্তি কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

আরও পড়ুন: সুনামগঞ্জে বালু উত্তোলন: ‘শর্ষের মধ্যেই ভূত’ বললেন স্থানীয়রা

নদীর কথিত ‘আসিব’ মোল্লা:
 

ধোপাজান নদী থেকে অবৈধ উপায়ে বালু উত্তোলন ও নৌকা নিরাপদে অপরাধী চক্রের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা পর্যন্ত নিয়ে যেতে প্রায় অধিকাংশ ব্যক্তিই যার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয় তাকে সবাই চেনেন ‘মোল্লা’ নামে। আগেকার দিনে যেভাবে গ্রামের মানুষ ছোট বাচ্চাদের নদীতে গোসল করতে না নামতে ভয় দেখাতেন ‘নদীতে আসিব আছে’ বলে। এখনও গ্রামের অনেকে শিশুদের এমন ভয় দেখান। শিশুদের ধারণা এই ‘আসিব’ নদীতে ডুব দিয়ে লুকিয়ে থাকা কোনো ‘কালো দানব’। যা নদীতে নামলে ধরে খেয়ে ফেলবে। নদীর সব এলাকাতেই এই ‘আসিব’ থাকে। ছায়েদ আলী মোল্লাও ধোপাজানের সর্বত্রই বিরাজ করেন বলে অভিযোগ গ্রামবাসীর, তাই তাকে অনেকেই ‘নদীর আসিব’ বলেও পরিচয় দেন।

আরও পড়ুন: হাজার কোটি টাকার বালু সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক পুলিশ, অসহায় ডিসি!

ধোপাজান নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলন ও লুটপাটসহ সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতের অন্ধকারে নৌকা বের করতে হলে ছায়েদ আলী মোল্লা নামে এই ব্যক্তি পুলিশের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে আগে থেকেই মধ্যস্থতা করে আসছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এ নদীতে এসআই জহিরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে ও জহিরের সঙ্গে কথা হয়েছে জানিয়ে ছায়েদ আলী মোল্লাসহ আরও ৩ ব্যক্তি নৌকার মালিকদের কাছ থেকে ঈদুল আজহার দুদিন আগে থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা আদায় শুরু করেন বলে বিস্তর অভিযোগ করেছেন মনিপুরীঘাট ও বালাকান্দা বাজারের একাধিক নৌকা মালিক। নৌকা বের করতে আদায় করা এই টাকা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছেও যাবে বলে প্রচার দেয় এই ৪ ব্যক্তি।

চাঁদরাতে যা ঘটে:

সময় সংবাদের কাছে নৌ শ্রমিকরা জানান, গেলো কয়েক মাস ধরে পুলিশ কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম রাত নামলেই সাদা পোশাকে ধোপাজানের বালু পাথর মহালে ঢুকে পড়ছেন। নিজ হাতে টাকা আদায় না করলেও তার দিক নির্দেশনা অনুযায়ী চক্রের ঘনিষ্ঠজনরা সুযোগ বুঝে নির্দিষ্ট কিছু টাকার বিনিময়ে বালু লুটে সহযোগিতার পাশাপাশি বালু বোঝাই নৌকা নিরাপদে ধোপাজান থেকে বের করতে কাজ করছেন। 

আরও পড়ুন: স্ট্যান্ডরিলিজের পরও বহাল তবিয়তে সুনামগঞ্জের ওসি নাজমুল

নৌ শ্রমিকদের পাশাপাশি মনিপুরিঘাট ও বালাকান্দা গ্রামের একাধিক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করে বলেন, ঈদে ছুটিতে যাওয়ার কথা ছিল এসআই জহিরের। তাই স্থানীয় একটি মহলকে সঙ্গে নিয়ে আগে থেকেই তিনি সম্ভাবতো পরিকল্পনা সাজিয়ে রেখেছিলেন। তার নির্দেশ ছাড়া যেহেতু এই নদীতে কোন সময় কোন অফিসার ডিউটি করবেন তা নির্ধারণ সম্ভব হয় না। তেমনি কোনো নৌকা বের করতে হলে তার সঙ্গে আগে কথা না বললে হয় না। সবশেষ গত ৬ জুন রাত ৮ টা থেকে পরদিন ঈদুল আজহার সকাল পর্যন্ত সময়ে ১০০ টি বালুবাহী নৌকা বের করতে নৌকাপ্রতি ৫ থেকে ১০ হাজার করে আদায় করা হয়। এ টাকা এসআই জহির পর্যন্ত পৌঁছেছে কিনা তা কেউ বলতে না পারলেও নদীতে দায়িত্বে থাকা জহিরের অধস্তন অন্য পুলিশ কর্মকর্তা নৌকাগুলো বের হতে সুযোগ দিতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন গ্রামবাসী।


অন্যদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে বার বার কড়া নজরদারির কথা বলা হলেও কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তার অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগে বিব্রত জেলা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নৌ শ্রমিক বলেন, ‘যে ৪ ব্যক্তি টাকা তুলেছে ১শ’ নৌকা থেকে তাদের আর খুঁজে পাই না আমরা। টাকা নিয়েও অনেকের নৌকা আবার পরে বড় নদীতে আটক হইসে, আবার অনেকে নৌকা বের করতে পারেনি, টাকাও ফেরৎ পায়নি।’


অভিযুক্ত ছায়েদ আলী মোল্লা বলেন, ‘জহির স্যারের সাথে কথা বলেই বালুর নৌকা বের করতে হয়। আবার খালি নৌকা নদীতে ঢোকার সময়ও তাকে না জানালে হয় না। তিনিই কখন কোন পুলিশ ডিউটি করতে হবে সেটা ঠিক করেন, তাই তাকে না জানিয়ে কিছুই সম্ভব না। তবে তিনি নিজ হাতে টাকা নিতে আমি দেখিনি।’

আরও পড়ুন: এবার দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সুনামগঞ্জের সেই ওসিকে বদলি

অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ছুটিতে ছিলাম, এসব ব্যাপারে কিছুই জানি না আমি। যারা অভিযোগ করেছে সবই মিথ্যা ও ভুয়া।’


সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) জাকির হোসেন বলেন, ‘আমি এমন অভিযোগের ব্যাপারে জানতাম না, খবর নিয়ে আমরা দেখছি, কোনোভাবেই অবৈধ উপায়ে নদীপথে বালু পাথর উত্তোলন ও পরিবহন আমরা হতে দেব না। নৌপথে অপরাধ কমিয়ে আনতে আমরা আমাদের এসপি মহোদয়ের নির্দেশে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি।’

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন