আফগানিস্তানে একজন চিকিত্সক হবার স্বপ্ন ছিল সালিহার। কিন্তু সেই স্বপ্নের অন্বেষায় স্কুলে ফেরত যাবার সব সম্ভাবনা হারিয়ে গেলে সে এখন অনলাইনে ক্লাস করছে।
২০২১ সালের আগস্ট মাসে যখন আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী সরে আসে এবং তালিবান ক্ষমতা দখল করে তখন সে নবম শ্রেণীর ছাত্রী ছিল।
১৮ বছর বয়সী সালিহা বলে, “আমি স্কুল শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু এখন সব ধরণের সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় নিয়ে আমার আশা হচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমে বা গোপন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যে কোন ধরণের শিক্ষা গ্রহণ”। নিরাপত্তার কারণে সালিহা তার পারিবারিক নাম জানাতে চায়নি।
তালিবান তার চতুর্থ বছরে এসে মেয়েদের জন্য মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে সালিহার মতো কিছু আফগান মেয়ে ও তরুণী শিক্ষার বিকল্প উত্স সন্ধান করছে।
জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী এই নিষেধাজ্ঞার কারণে আফগানিস্তানে ১৪ লক্ষেরও বেশি মেয়ে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
তালিবান শাসনামলে নারীদের উপর বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষা অর্জন, সরকারি বা বেসরকারি সংগঠনগুলিতে কাজ করা এবং পার্ক, জিম ও বিউটি স্যালুনে মেয়েদের যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
অন্যান্য আফগান কন্যা ও তরুণীদের মতো সালিহা এবং তার চার বোনকে বাড়িতেই থাকতে হবে, কিন্তু সে বলেছে সে তার শিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে প্রতিজ্ঞ।
অন লাইনে শিক্ষা গ্রহণ অব্যাহত রাখার ব্যাপারে বলে, “ আমি একটি কম্পিউটার কেনার জন্য এবং ইন্টারনেটের খরচ মেটানোর জন্য একেকটি পয়সা করে জমিয়েছি”।
কিন্তু অনলাইনে শিক্ষা গ্রহণের মতো সামর্থ সব আফগান মেয়েদের এবং নারীদের নেই।
একটি গ্যালপ জরিপে দেখা গেছে যে ২০২২ সালে আফগানিস্তানের মাত্র ৬% নারী ইন্টারনেটের নাগাল পেতেন, সেই তূলনায় পুরুষদের মধ্যে ২৫% ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারতেন।
প্রয়োজন পরিবর্তনের সুযোগ রাখার
লার্ন আফগনিস্তান নামের সে দেশের একটি ডিজিটিাল স্কুল নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা পাশতানা দুররানি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, আফগানদের কম্পিউটারে শিক্ষা গ্রহণের বিভিন্ন কারণ থাকায়, তাঁর সংগঠন বিভিন্ন ধরণের শিক্ষার মডেল দিয়ে থাকে।
দুররানি বলেন, “এক পরিমাপের বিষয়টা আফগানিস্তানে খাটে না। তাই এর মূল বিষয়টা হচ্ছে এটি নমনীয় এবং প্রতিটি সমাজের প্রতি যাতে সাড়া দিতে পারে, তেমন করেই বানানো হয়েছে”।
অনলাইনে ক্লাস ছাড়াও দুররানির সংগঠনটি ছয়টি প্রদেশে গোপনে স্কুল পরচিালনা করে, যেখানে প্রায় ৭০০ জন মেয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে।
তবে তিনি বলেন যাতে আরও মেয়েরা এই সব ক্লাসে যোগ দিতে পারে সে জন্য স্থানীয় বয়স্ক লোকদের সঙ্গে কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে।
আফগানিস্তানে নারীদের ক্ষমতায়নের ব্যাপারে কাজ করছে এমন একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সাহার এডুকেশানের নির্বাহী পরিচালক মিত্রা আলোকোজায় ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন এটা জরুরি যে পরিবারের নারী সদস্যাদের অনলাইন কিংবা আন্ডারগ্রাউন্ড ক্লাসে যুক্ত হতে পুরুষ সদস্যরা তাদের সহায়তা প্রদান করে।
আলোকোজায় বলেন, “ আমরা চাই শিক্ষা গ্রহণের প্রচেষ্টায় পুরুষরা যেন তাদের কন্যাদের এবং বোনদের সহায়তা করেন”।
তবে তিনি বলেন ক্ষমতায় তালিবানের প্রত্যাবর্তন আফগানিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলেছে।
ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে প্রাথমিক স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ২০১৯ সালে ৬৮ লক্ষ থেকে নেমে ২০২২ সালে ৫৭ লক্ষে দাঁড়ায়।
এই নিষেধাজ্ঞা ইতোমধ্যেই নারী ও মেয়েদের বড় রকমের ক্ষতি করেছে।
দমন-নিপীড়নের আশংকায় নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে কাবুলে প্রাথমিক স্কুলের একজন শিক্ষক ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ২০২১ সালে তালিবানের ক্ষমতা নেওয়ার পর, বাবা-মায়েরা ৬ষ্ঠ ক্লাস শেষ করার আগেই তার কয়েকজন ছাত্রীকে স্কুল থেকে সরিয়ে নেন।
ওই শিক্ষক বলেন, “তার অল্প পরেই দু জনের বিয়ে হয়ে যায়, তাদের ঠিক বয়সটা আমার মনে নেই কিন্তু আমি এটা জানি তাদের বয়স ১৩ বছরের বেশি নয়”।
মানসিক সমস্যা
একজন নির্বাসিত মানবাধিকার নজরদারী সংস্থা রাওয়াদারি এ মাসে বলে যে আফগানিস্তানে মেয়েদের মানসিক স্বাস্থের অবনতি ঘটছে এবং সেখানে আত্মহত্যার প্রচেষ্টাও বেড়েই চলেছে। তার উপর রয়েছে বাধ্যতামূলক বিয়ে।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয় যে আফগানিস্তানে,“নারী শিক্ষার উপর নিষেধাজ্ঞার কারণে নারীদের উপর সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে যা মেয়েদের ও নারীদের জীবনকে দূর্বিসহ করে তুলছে”।
সাহার শিক্ষার আলোকজায় বলেন,“আফগানিস্তানে কি চলছে সে সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। অনেকেই, এমন কী যুক্তরাষ্ট্রেও এ ব্যাপারে জানেন না”।
সালিহা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলছেন তারা যেন “আফগান মেয়েদের একা ছেড়ে না যায়”।
তিনি বলেন,“আমাদের নিয়ে ভাবুন, আমাদের নিয়ে লিখুন, আমাদের শেখার সুযোগ দিন এবং এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করতে সাহায্য করুন। যদি একটি দরজা বন্ধ হয়ে যায়, অমাদের অন্যটি পেতে সাহায্য করুন”।
এই প্রতিবেদনটি এসেছে ভয়েস অফ আমেরিকার আফগান বিভাগ থেকে।