গত মঙ্গলবার (১১ মার্চ) বেলুচিস্তানে পেশোয়ারগামী জাফর এক্সপ্রেস ট্রেনে নজিরবিহীন হামলা চালায় বিএলএ। জিম্মি করা হয় ট্রেনের অন্তত ৪০০ যাত্রীকে। ঘটেছে বহু হতাহতের ঘটনাও। ভয়াবহ ওই হামলার পর নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে বিএলএ।
১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে প্রতিষ্ঠিত হয় সংগঠনটি। প্রথমে দাবি ছিল প্রদেশের জন্য বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন। পরে সরাসরি স্বাধীনতার দাবিতে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে তারা। সংগঠনের বর্তমান নেতৃত্বে রয়েছেন বশির জায়েব বেলুচ। বিশ্লেষকরা বলছেন, সংগঠনটি শুধু সশস্ত্র হামলাই নয়, কার্যকরী প্রচারনীতির মাধ্যমেও তরুণদের আকৃষ্ট করছে।
কায়েদ-ই-আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা বিশ্লেষক মুহাম্মাদ শোয়াইব-এর মতে,
বিএলএ সংবাদে থাকার কৌশল রপ্ত করেছে এবং একাধিক ফ্রন্টে বিভক্ত হয়ে রাষ্ট্রকে ব্যস্ত রাখছে। হামলা ও ফ্রন্টের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে এটা স্পষ্ট যে, বিএলএ’র সদস্য বাড়ছে এবং এখন তারা অভিযানের জন্য আরও বেশি সম্পদ ও জনশক্তি নিয়োজিত করতে পারছে।
বেলুচিস্তান পাকিস্তানের সবচেয়ে বড়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া প্রদেশ। খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ হলেও স্থানীয় জনগণের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকার তাদের সম্পদের সুবিধা নিয়ে তাদের অবহেলিত রাখছে। বিশেষ করে চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর এবং গভীর সমুদ্রবন্দর গওয়াদারের প্রকল্পকে ঘিরে ক্ষোভ বেড়েছে। বেলুচ নেতাদের দাবি, এসব প্রকল্প থেকে বেলুচ জনগণের কোনো লাভ হচ্ছে না, বরং তাদের আরও প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ট্রেনে সন্ত্রাসী হামলার জন্য ভারতকে দায়ী করল পাকিস্তান
বিএলএ মূলত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী, নিরাপত্তা বাহিনী এবং চীনা প্রকল্প ও নাগরিকদের ওপর হামলা চালিয়ে থাকে। ২০১৮ সালে করাচিতে চীনা কনস্যুলেটে হামলা এবং ২০২২ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক চীনা অধ্যাপককে হত্যা সংগঠনটির বহুল আলোচিত হামলার অংশ। সাম্প্রতিক জাফর এক্সপ্রেস ট্রেনে হামলা তাদের ক্রমবর্ধমান সক্ষমতারই ইঙ্গিত দেয়। বিশ্লেষকদের মতে, বিএলএ’র এই হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
বর্তমানে সংগঠনটির নেতৃত্বে রয়েছেন বশির জাইব বালোচ, যিনি একসময় বেলুচ ছাত্র সংগঠনের নেতা ছিলেন। এছাড়াও হাম্মাল রেহান নামে একজন নেতা সংগঠনের ‘মাজিদ ব্রিগেড’ পরিচালনা করেন। বিএলএ’র অর্থায়নের উৎসও বিতর্কিত।
পাকিস্তান সরকারের দাবি, বিএলএ আফগানিস্তান ও ইরানের মাটিতে ঘাঁটি গেড়েছে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থায়ন পায় তারা। তবে বিশ্লেষকদের মতে, মাদক পাচার, চাঁদাবাজি ও খনিজ সম্পদের অবৈধ বাণিজ্য থেকেই বিপুল পরিমাণ অর্থ পায় তারা।
আরও পড়ুন: পাকিস্তানে পুরো ট্রেন ‘ছিনতাই’ /৫০০ যাত্রীকে জিম্মি, উদ্ধারের চেষ্টা করলেই হত্যার হুমকি!
ইসলামাবাদ-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিওপলিটিক্যাল ইনসাইটস-এর পরামর্শক ফাহাদ নাবিল বলেন,
বিএলএ’র বেশিরভাগ নেতৃত্ব ইরান ও আফগানিস্তান থেকে পরিচালিত হচ্ছে। এই গোষ্ঠী বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ড— যেমন মাদক পাচার ও মুক্তিপণের জন্য অপহরণের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। এছাড়া বেলুচ প্রবাসী সম্প্রদায়ের কিছু ব্যক্তিও অর্থায়ন করে থাকে।
তাদের প্রশিক্ষণ ইরান, আফগানিস্তান ও বেলুচিস্তানের কিছু এলাকায় হয়, আর অস্ত্র সংগ্রহ করা হয় ইরান ও আফগানিস্তানের কালোবাজার থেকে। পাশাপাশি আফগানিস্তানে ফেলে যাওয়া মার্কিন অস্ত্রও তারা ব্যবহার করে বলে জানান ফাহাদ নাবিল।
আরও পড়ুন: পাকিস্তানে ছিনতাই হওয়া ট্রেন থেকে সব জিম্মি উদ্ধার
বিএলএ’র ক্রমবর্ধমান কার্যক্রম পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে চীনের বিপুল বিনিয়োগকে লক্ষ্য করে হামলা চালানোর কারণে আন্তর্জাতিক মহলেও উদ্বেগ বাড়ছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হয়তো সাময়িকভাবে হামলা দমন করেছে, কিন্তু বেলুচিস্তানের হতাশাগ্রস্ত তরুণদের কাছে বিএলএ’র প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। আর এই সংঘাত কতদূর গড়াবে, তার উত্তর সময়ই বলে দেবে।
]]>