চা বিক্রির টাকায় চলে শুভ চন্দ্রের পাঠশালা

৬ দিন আগে
খোলা আকাশের নীচে পাঠাশালা। বেশ উৎসাহের সাথে উচ্চস্বরে আদর্শলিপি পড়ছে কোমলমতি শিশুরা। এমন দৃশ্য দেখে থমকে যান পথচারিরা। মুগ্ধ হয়ে শোনেন শিশুদের পড়া। পাঠশালাটির নাম ‘লাল সবুজের পতাকা শ্রী শুভ চন্দ্র প্রাথমিক শিশু বিদ্যালয়।’ নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় রেলস্টেশনের প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তে উন্মুক্ত স্থানে দেখা মিলবে এই বিদ্যালয়ের।

২০১৬ সালের ১১ মার্চ নিজ উদ্যোগে ভাসমান বিদ্যালয়টি গড়ে তোলেন বাবা-মা হারা দরিদ্র পরিবারের তরুণ সন্তান শুভ চন্দ্র দাস।

 

দীর্ঘ আলাপচারিতায় সময় সংবাদের এই প্রতিবেদককে শুভ চন্দ্র জানান, ছাত্রজীবনে তার খুব ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজের উপার্জনে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু হঠাৎ মায়ের গুরুতর অসুস্থতায় ভেঙে যায় শুভ চন্দ্রের স্বপ্ন। এক পর্যায়ে অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার খরচ জোগাতে লেখাপড়া ছেড়ে পাঁচ সদস্যের পরিবারের হাল ধরতে বাধ্য হন তিনি। অষ্টম শ্রেণি পাশ করে বন্ধ হয়ে যায় তার লেখাপড়া। তবে মায়ের মৃত্যুর পর মনের একমাত্র ইচ্ছা পূরণ করতে নেমে পড়েন জীবন সংগ্রামে।

 

শুভ চন্দ্র দাস আরও জানান, কিছুদিন গার্মেন্টস কারখানায়, আবার কিছুদিন ফার্ণিচারের দোকানে স্বল্প বেতনে কাজ করেন। তবে এই কাজ করে পরিবারের খরচ চালানো দূরের কথা, নিজের হাত খরচও জুটতো না। স্কুল গড়ার স্বপ্নতো সোনার হরিণ। একদিন অবসর সময় রেল স্টেশনে বসে অবচেতন মনে ভাবছিলেন নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন আর কিভাবে স্কুল গড়ার স্বপ্নটি বাস্তবায়ন করা যায়। ঠিক সেসময় আশপাশে ছিন্নমূল শিশুদের অবহেলিত অবস্থায় দেখে শুভ চন্দ্র তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নেন রেল স্টেশনেই গড়বেন তার স্বপ্নের বিদ্যালয়। শিক্ষার আলো ছড়াবেন সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের মাঝে। তখন থেকেই শুরু হয় শুভ চন্দ্রের ভাসমান বিদ্যালয়ের যাত্রা। কাজ ছেড়ে দিয়ে রেল স্টেশনে শুরু করেন চায়ের দোকানদারি। সেই আয়ের অর্থ দিয়ে বই, খাতা, পেন্সিল কিনে তুলে দেন সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের হাতে। দোকানের পাশেই বেঞ্চ বসিয়ে আর সাইনবোর্ড টানিয়ে শুরু করেন শিক্ষকতা।

 

আরও পড়ুন: নদী ভাঙনের কবলে উচ্চ বিদ্যালয়, রক্ষার দাবি শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের

 

শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন বিকেল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে আত্মনিয়োগ করেন শুভ চন্দ্র দাস।

 

প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যালয়ের মতোই নিয়মকানুন ও আনুষ্ঠানিকতা মেনে চলছে শুভ চন্দ্রের এই ভাসমান বিদ্যালয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে, জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে এবং শপথ পাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পাঠদান। আদর্শলিপি বই পুরোপুরি মুখস্থ হলে মেধা অনুযায়ি এই শিশুদের নিজ উদ্যোগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন শুভ চন্দ্র। প্রাথকিম স্কুলের গন্ডি অতিক্রম করলে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও ভর্তি করান তিনি।

 

রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ের মধ্যেও চলে শুভ চন্দ্রের পাঠদান। তবে অধিক বৃষ্টি হলে ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। তাই বিদ্যালয়টির কার্যক্রম স্থায়ীভাবে পরিচালনা করতে একটি নির্দিষ্ট ঘর কিংবা সামান্য কিছু জায়গার প্রয়োজন বলে জানান শুভ চন্দ্র। এ বিষয়ে সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিরাসহ জেলা প্রশাসকের সহযোগিতা কামনা করছেন তিনি।

 

সমাজের অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে শুভ চন্দ্রের এই মহৎ উদ্যোগকে ইতিবাচক এবং প্রগতিশীল হিসেবে দেখছেন নগরবাসি। তারাও চান পথশিশুদের আলোকিত করা এই ভাসমান পাঠশালাটি প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যালয়ে পরিণত হোক।

 

রেলস্টেশনে খোলা আকাশের নিচে সুবিধাবঞ্চিত ছিন্নমূল শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়ানো শুভ চন্দ্রের বিদ্যালয়ের বিষয়ে জানা নেই বলে জানান নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা। ভাসমান বিদ্যালয়টির বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি।

 

আরও পড়ুন: ঠিকাদারের গাফিলতিতে বিড়ম্বনায় তিন বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা

 

বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা সময় সংবাদকে বলেন, "আমরা এই শিশুদের জন্য অনেক কিছু করতে পারি। আমরা তাদের ড্রেস দিতে পারি।।বই খাতা ও ব্যাগ সহ আনুষাঙ্গিক প্রয়োজনীয় সামগ্রিগুলো দিতে পারি। আমরা শুভ চন্দ্রের বিদ্যালয়টি পরির্শনে যাবো। আমরা যদি দেখি সে সত্যি পথিশুদের জ্ঞাণের আলোয় আলোকিত করছে তাহলে আমরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করব।

 

গত দশ বছরে দুই শতাধিক পথ শিশুকে বাল্যশিক্ষায় দীক্ষিত করেছেন শুভ চন্দ্র দাস। তাদের মধ্যে অন্তত ২০ জন শিশু তারই সহযোগিতায় এখন বিভিন্ন মাধ্যমিক স্কুলে অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে পড়ছে। শুভ চন্দ্রের এই বিদ্যালয়ে বর্তমানে ৩৫ জন পথশিশু বাল্যশিক্ষায় দীক্ষিত হচ্ছে।

 

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন