অভিযোগ আছে, গেল কয়েক বছর ধরে লাইসেন্স বাবদ প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর কাছে ঘুষ হিসেবে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে নিয়ে আসছে টিটিসি কর্তৃপক্ষ। এতে প্রশিক্ষণার্থীদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করলেও ভয়ে মুখ খুলেননি কেউ। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে এই বিষয়টি নিয়ে পোস্ট করেন দেলোয়ার হোসেন নামে টিটিসি'র ইলেকট্রনিক্স বিভাগের এক প্রশিক্ষক। এতে নড়েচড়ে বসে প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অনেকে। খবরটি ছড়িয়ে পড়ে প্রশাসনিক দপ্তরগুলোতেও।
পোস্টে তিনি লেখেন, ‘ঠাকুরগাঁও টিটিসির দেশ-বিদেশের খন্ডকালীন প্রশিক্ষক ফারুক হোসেন ১ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা তোলেন। যিনি ঠাকুরগাঁও বিআরটিএ অফিসের দালাল হিসেবে পরিচিত। একই প্রতিষ্ঠানের অটোমোটিভ ট্রেডের চিফ ইন্সট্রাক্টর সাদেকুল ইসলাম সরাসরি এই ঘুষ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত। শুধু বিগত ব্যাচের ৭০ জন নন এযাবৎ পাসকৃত সকল ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের পাসকৃত ছাত্রদের মোবাইল মারফত (যা প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষিত আছে) এর সত্যতা পাওয়া যাবে।’
তিনি আরো লেখেন, ‘আমি মোঃ দেলোয়ার হোসেন, প্রশিক্ষক (ইলেকট্রনিক্স) টিটিসি। প্রতিবাদ করলে আমাকে হুমকি প্রদান ও বিভিন্ন সময়ে হয়রানি করা হয়। আর কে কে জড়িত তা আমি জানি। বিআরটিএ নয় বরং বিআরটিএর নাম ভাঙ্গিয়ে এই টাকা উত্তোলন করা হয়। উত্তোলনকৃত টাকা বিআরটি অফিসে প্রদান করা হয় কিনা তা জানি না। উক্ত ঘটনার রাজসাক্ষী হিসাবে কাজ করতে বিন্দু পরিমাণ পিচপা হবো না।’
এ ঘটনার পর প্রশিক্ষক দেলোয়ার হোসেনকে গেল ১৭ মে শোকজ করেন প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সামছুর রহমান।
এ বিষয়ে দেলোয়ার হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, নিজেদের অনিয়ম-দুর্নীতি ঢাকতেই তারা সকলেই একত্রিত হয়ে আমাকে শোকজ করেছে এবং তিন দিনের মধ্যে জবাব দিতে একটি নোটিশও দিয়েছেন। তবে আমি যা সত্য তাই বলেছি। দুদক তদন্ত করলেই সব বেরিয়ে আসবে।
গেল ৭ মে দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত ঠাকুরগাঁও জেলা কার্যালয়ের একটি দল বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) অফিসে অভিযান চালায়।
অভিযান শেষে দুদকের কর্মকর্তারা জানান, ঠাকুরগাঁও সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি'র) ৭০ জন প্রশিক্ষণার্থী তিন মাসের একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন এবং তাদের প্রত্যেকের কাছে ২৫০০ টাকা করে মোট ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা লাইসেন্স দেওয়া হবে মর্মে টিটিসি কর্তৃপক্ষ আদায় করে। দুদকের কর্মকর্তারা তথ্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নেমেছে।
আরও পড়ুন: সরিষাবাড়ী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুদকের অভিযান
পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ড্রাইভিং লাইসেন্সের নামে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর কাছে থেকে ৪ হাজার টাকা করে চাওয়া হয়। ভারি যানবাহনের জন্য ৩ হাজার ৫০০ ও হাল্কা যানের জন্য ২ হাজার ৫০০ টাকা নেয় দেশ-বিদেশের খন্ডকালীন প্রশিক্ষক ফারুক হোসেন। যারা টাকা দিয়েছে তাদেরই শুধু লাইসেন্স প্রাপ্তি পরীক্ষায় পাশ করে দেওয়া হয়েছে। আর যারা দেয়নি তাদের অকৃতকার্য দেখনো হয়।
তবে সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে প্রতিষ্ঠান থেকে দ্রুত সটকে পড়েন ফারুক হোসেন ও অটোমোটিভ ট্রেডের প্রধান প্রশিক্ষক সাদেকুল ইসলামসহ অন্যরা।
তবে এ ঘটনায় কৌশলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সামছুর রহমান ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার নামে কোনো অর্থ নেওয়া হয়নি মর্মে প্রশিক্ষণার্থীদের কাছে একটি লিখিত নেন।
ভুক্তভোগী কয়েকজন প্রশিক্ষণার্থী অভিযোগ করেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে ঘুষ না দিলে অকৃতকার্য করা হতো।
এদের মধ্যে একজন বলেন, একটি প্রশিক্ষণে আমরা ৮০ জন ছিলাম, তারমধ্যে ১০ জন টাকা দিতে পারেনি তাই তাদের লাইসেন্স দেয়া হয়নি। এছাড়াও সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের প্রতিদিন ১৫০ টাকা করে দেওয়ার কথা থাকলে এটাও নিয়মিত দেন না কর্তৃপক্ষ। প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য ২/৩ লিটার তেল বরাদ্দ থাকলেও টিটিসি কর্তৃপক্ষের আমাদের জন্য আধা লিটার তেলও খরচ করে না। তারা প্রতিটি কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি করে আসছে যা দেখার কেউ নেই।
আরও পড়ুন: উপদেষ্টা আসিফের সাবেক এপিএসের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন
অভিযোগের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের খন্ডকালীন প্রশিক্ষক ফারুক হোসেন ও অটোমোটিভ ট্রেডের প্রধান প্রশিক্ষক সাদেকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ফারুক হোসেন অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, প্রশিক্ষণার্থীদের কাছে কোন অর্থ নেয়া হয় না। কিছু শিক্ষক ও ছাত্র তার নামে মিথ্যা বানোয়াট কথা বলে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। আর যারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও কথা জানান তিনি।
এমন নানা অনিয়মের বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সরকারী কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (টিটিসি'র) ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সামছুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কোনো প্রশিক্ষণার্থীর কাছে টাকা নেয়া হয়নি। কেউ যদি টাকা নিয়ে থাকে তা অজানা। আর যেই শিক্ষক অভিযোগ তুলে ফেসবুকে লিখেছে তাকে এরইমধ্যে শোকজ করা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট প্রমাণ করতে না পারলে নেয়া হবে ব্যবস্থা।
এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত ঠাকুরগাঁও জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আজমির শরিফ মারজী বলেন, লাইসেন্স দেয়া বাবদ ৭০ জন প্রশিক্ষণার্থীর কাছে টাকা নিয়েছি টিটিসি কর্তৃপক্ষ এমন অভিযোগ আমরা পেয়েছি। আমাদের তদন্ত চলমান রয়েছে। তদন্ত শেষ হলে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে।