মাধবপুর চা-বাগানের অভ্যন্তরে অবস্থিত লেকটি শুধু একটি জলাধার নয়, যেন স্বপ্নের কোনো জগৎ। নীল আকাশের প্রতিফলন মিশে থাকে স্বচ্ছ জলে, তার মাঝে ছড়িয়ে থাকে লাল-সাদা শাপলা ফুলের হাসিমুখ। খানিকটা দূরে নজর কাড়ে সবুজে মোড়ানো সারি সারি চা-গাছ, যার মাঝখানে ছায়াঘেরা গাছপালা আর পাখির কিচিরমিচিরে পরিবেশ যেন হয়ে ওঠে আরও জীবন্ত।
মাধবপুর লেকের বিশেষত্বই এর ঋতুভেদে পাল্টে যাওয়া রূপ। শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষা- প্রতিটি ঋতুতে ভিন্ন সাজে সেজে ওঠে এই লেক। তবে বর্ষায় এর মোহনীয়তা চোখে পড়ার মতো। শ্রাবণের হালকা বাতাসে দুলে ওঠে পদ্মপাতায় মোড়ানো জল। ঘুঘুর ডাক, ঝিরঝিরে হাওয়া আর সবুজের সমারোহ মিলিয়ে এক অনন্য অনুভূতির জন্ম দেয়।
পর্যটকদের পদচারণা
ঢাকা, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এমনকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিদিনই অসংখ্য পর্যটক ভিড় করছেন মাধবপুর লেকে। সকালে আসা দর্শনার্থীরা সন্ধ্যা পর্যন্ত এই লেকপাড়েই কাটিয়ে দেন। কেউ হাঁটেন পাহাড়ি লালচে মাটির পথ ধরে, কেউ বা আবার জিরিয়ে নেন ছাউনির নিচে বসে পাহাড়ি বাতাসে। টিলার চূড়ায় উঠে দূরের নীল-আকাশ আর সবুজ-বনের অপূর্ব মিলন চোখে পড়ে, যা অনেকের কাছে স্বপ্নের মতোই অবিশ্বাস্য।
ঢাকা থেকে আসা পর্যটক লামিয়া মাধবপুর লেককে “একটি একেবারে ফটোজেনিক জায়গা” বলে মন্তব্য করেন। অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিমুল বলেন, “এমন সবুজের নির্জনতা ঘেরা জায়গা সত্যিই চমৎকার, মনটা জুড়িয়ে যায়।”
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
চা-বাগান কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৫ সালের দিকে মাধবপুর চা-বাগানের তিনটি টিলা ঘিরে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে এই লেকটি তৈরি করা হয়। বর্তমানে লেকটির আয়তন প্রায় ৫০ একর, দৈর্ঘ্যে ৩ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ৫০ থেকে ৩০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।
যেভাবে যাবেন
মাধবপুর লেকে পৌঁছানোর জন্য সড়ক ও রেল যোগাযোগ বেশ সহজলভ্য।
বাসযাত্রা: ঢাকা থেকে বাসযোগে সরাসরি মৌলভীবাজার বা শমসেরনগর পর্যন্ত যাওয়া যায়।
ট্রেনযাত্রা: ঢাকা থেকে উদয়ন, জয়ন্তিকা বা পারাবত এক্সপ্রেসে সিলেটগামী ট্রেনে উঠলে শমসেরনগর রেলস্টেশন নেমে সিএনজি বা লোকাল পরিবহনে লেক পর্যন্ত যাওয়া যায়।
স্থানীয় যাতায়াত: শমসেরনগর থেকে মাধবপুর লেক প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে। সিএনজি, মোটরসাইকেল বা ভাড়ায় চালিত অটো রিকশায় সহজেই পৌঁছানো যায়। সেখানে পর্যটকদের জন্য রয়েছে ছোট ছোট চায়ের দোকান ও বসার স্থান।
আরও পড়ুন: ঘুরে আসুন দেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রামে
কোথায় থাকবেন
মাধবপুর লেক চা-বাগানের ভেতরে বা একেবারে আশেপাশে এখনো কোনো বড় ধরনের রিসোর্ট বা হোটেল গড়ে ওঠেনি। তবে পর্যটকদের জন্য কিছু বিকল্প রয়েছে। কমলগঞ্জ শহরে ও শমসেরনগরে কিছু মধ্যম মানের আবাসিক হোটেল ও রেস্ট হাউস রয়েছে।
যারা প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকতে চান, তারা শ্রীমঙ্গল বা লাউয়াছড়া সংলগ্ন রিসোর্টগুলোতে অবস্থান করে মাধবপুর লেকে একদিনের ভ্রমণ করতে পারেন।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা
মাধবপুর লেকে স্থানীয় চা-বাগান কর্তৃপক্ষ ও ট্যুরিস্ট পুলিশ মাঝে মধ্যে নজরদারি রাখেন। যদিও এখানে তেমন কোনো বড় ধরনের অপরাধের তথ্য পাওয়া যায় না, তবুও: পর্যটকদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের প্রতি খেয়াল রাখতে পরামর্শ দেওয়া হয়। সন্ধ্যার পর নির্জন এলাকায় না ঘোরার পরামর্শ দেন স্থানীয়রা। লেকের কিছু জায়গা ঢালু ও পিচ্ছিল হওয়ায় বৃষ্টির দিনে সাবধানে চলাফেরা জরুরি।
আরও পড়ুন: আরও পড়ুন: ঘুরে আসুন খাগড়াছড়ির 'নিউজিল্যান্ডে'
গাইড ও পর্যটন সহায়তা
বর্তমানে সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনো নির্ধারিত ট্যুর গাইড ব্যবস্থা নেই। তবে, স্থানীয় কয়েকজন যুবক অল্প পারিশ্রমিকে ভ্রমণ গাইডের কাজ করেন। ট্যুর গ্রুপ বা প্রাইভেট ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে গেলে গাইড সুবিধা পাওয়া যায়। মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন এবং পর্যটন কর্পোরেশন ভবিষ্যতে মাধবপুর লেককে ঘিরে তথ্য কেন্দ্র ও গাইড সুবিধা চালুর পরিকল্পনা করেছে।
প্রকৃতির অদ্ভুত মায়া আর শান্তির পরশে মোড়া মাধবপুর লেক, বাংলাদেশের পর্যটন মানচিত্রে এক উজ্জ্বল নাম হয়ে উঠেছে। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এটি শুধু একটি গন্তব্য নয়, বরং এক অপার্থিব অভিজ্ঞতা। বর্ষার সৌন্দর্য আর সবুজের মনকাড়া ছোঁয়ায় যে কেউ ফিরে যাবেন প্রাণের প্রশান্তি নিয়ে।