পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
فَکُلُوۡا مِنۡہَا وَ اَطۡعِمُوا الۡقَانِعَ وَ الۡمُعۡتَرَّ ؕ کَذٰلِکَ سَخَّرۡنٰہَا لَکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ অতঃপর তখন তোমরা তা হতে আহার কর এবং আহার করাও ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকে ও প্রার্থনাকারী অভাবগ্রস্তকে। এইভাবে আমি ওদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছি; যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (সুরা হজ্জ আয়াত নং ৩৬)
কোরবানির গোশত তিন ভাগে ভাগ করা মুসতাহাব। এক ভাগ নিজের জন্যে আরেক ভাগ আত্মীয়-স্বজনের জন্যে এবং আরেক ভাগ গরিব মিসকিনদেকে হাদিয়া দেওয়ার জন্যে। এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-
আরও পড়ুন: আগে ঋণ পরিশোধ করবে নাকি কোরবানি করবে?
كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ لُحُومِ الأَضَاحِي فَوْقَ ثَلاَثٍ لِيَتَّسِعَ ذُو الطَّوْلِ عَلَى مَنْ لاَ طَوْلَ لَهُ فَكُلُوا مَا بَدَا لَكُمْ وَأَطْعِمُوا وَادَّخِرُوا রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোরবানির গোশত তিন দিন পরে খেতে আমি তোমাদেরকে বারণ করেছিলাম, যেন সম্পদশালীরা উদারহস্তে তাদের গোশত দরিদ্রদের মধ্যে দান করে। এখন তোমরা ইচ্ছামত তৃপ্তিসহকারে তা খাও, অন্যকে খাওয়াও এবং জমা করেও রাখতে পার। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ১৫১০)
আরেকটি হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে-
فَكُلُوا وَادَّخِرُوا وَتَصَدَّقُوا এখন তোমরা খেতে পার, জমা করে রাখতে পার এবং সাদাকাহ করতে পার। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৪৯৯৭)
উক্ত আয়াত এবং হাদিস শরীফ দ্বারা পরিষ্কার হয়ে যায় কোরবানির গোশত নিজে খাওয়া, অন্যকে দেওয়া এবং জমিয়ে রাখা সবই বৈধ। সুতরাং এতে শরীয়ত কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ করেনি। তাই কারো জন্য তাতে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা কোনভাবেই সঠিক পথ ও পন্থা হতে পারেনা।
বর্তমানে আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কোরবানির গোশতের এক তৃতীয়াংশ বাধ্যতামূলকভাবে সমাজের কাছে হস্তান্তর করতে হয়। এ গোশত ধনী-গরীব (যারা কোরবানি দিয়েছে কিংবা দেয়নি) সবার মাঝে সমান হারে বন্টন করা হয়। এর সমর্থনে শরীয়তে কোন দলিল প্রমাণ বর্ণিত নেই।
উপরন্ত গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে এতে এমন কিছু বিষয় পরিলক্ষিত যার কারণে সামাজিক গোশত সংগ্রহ ও বন্টনের এই প্রথা শুধু অন্যায় ও অবৈধ মনে হয় না; বরং যারা তা পরিচালনা করে তারা কবিরা গুনাহগার হিসেবে সাব্যস্ত হবেন। নিম্নে কয়েকটি বিষয় বর্ণনা করছি-
এক. কোরবানির গোশতের এক তৃতীয়াংশ গরিবদের মাঝে বিতরণ করা আবশ্যক নয়; বরং মুস্তাহাব তথা উত্তম। তাহলে সমাজের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে শরীয়ত যাকে আবশ্যক করেনি তাকে আবশ্যক করে দেওয়া। যা সম্পূর্ণ অনুচিত।
দুই. নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলকে একত্রিত করে ঈদের নামাজ পড়েছেন; কিন্তু সকলের গোশতের এক তৃতীয়াংশ একত্রিত করে নিজেও বন্টন করেননি এবং কাউকে বন্টন করার আদেশও দেননি। অথচ নবীজির যুগে গরিব সাহাবাদের সংখ্যাই বেশি ছিল।
তিন. কারো কোরবানি মান্নতের হতে পারে, আর মান্নতের কুরবানীর গোশত ধনী মানুষ এবং নিজের পরিবারের লোকজন খেতে পারেন না। তাহলে তা সেখানে যুক্ত হয়ে ধনীদের বাড়িতেও চলে যাবে এবং নিজের বাড়িতেও ফিরে আসবে।
চার. কোন প্রয়োজন বা অন্য কোন কারণে কেউ গোশত বন্টনে আগ্রহী থাকেন না; কিন্তু সমাজের বাধ্যবাধকতার কারণে ও চক্ষু লজ্জায় সমাজকে গোশত দিতে বাধ্য হন। কারো জিনিস তার সন্তুষ্টি ব্যতীত নেওয়া বৈধ নয়।
আরও পড়ুন: কোরবানি না দিয়ে সেই অর্থ দান করা নিয়ে ইসলাম কী বলে?
পাঁচ. এজাতীয় কাজকর্মের মাঝে আরেকটি অসুবিধা হচ্ছে, লোকদের মাঝে পরস্পরে মতানৈক্য ও ঝগড়া বিবাদের সূত্রপাত ঘটে। এর দ্বারা সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয় এবং মানুষ বিভিন্ন ধরনের গুনাহের কাজ যথা হিংসা-বিদ্বেষ, গীবত-শেকায়েত ইত্যাদিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
এ সকল বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য করলে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় কোরবানির গোশত সামাজিকভাবে সংগ্রহ করা এবং বন্টন করা কোনভাবেই বিশুদ্ধ হতে পারে না। তাই উক্ত কাজে সারাদিন কষ্ট ও মেহনত করে সওয়াব পাওয়া তো দূরের কথা; বরং আরো গুনাগার হতে হবে।
তাই আসুন! আমরা সকল বিষয় হক্কানী ওলামায়ে কেরামের নির্দেশনা মোতাবেক বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা করি। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তৌফিক দান করেন, আমিন।
তথ্যসূত্র: রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৮, ফাতাওয়ে হিন্দিয়া ৫/৩০০, বায়হাকী ৬/১৮৬, বাদায়ে সানায়ে ৫/৮১, ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত ১১/২৫৮-২৬৫)
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ ঢাকা
খতিব, আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ পরিচালক, দাওয়াতুস সুন্নাহ বাংলাদেশ