ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের প্রথম সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ মুসাভি খোমেইনি, যাকে আয়াতুল্লাহ খোমেইনি নামে সবাই চেনেন। খোমেইনি ১৯৮৯ সালে মারা যান। তখন উত্তরসূরি কে হবেন, তা নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। ওই সময় ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে একজন মারজা-ই-তাকলিদ (ধর্মীয় দিক থেকে শ্রেষ্ঠ অনুসরণীয় ব্যক্তি) হওয়া আবশ্যক ছিল। যেমনটা ছিলেন রুহুল্লাহ খোমেইনি। তিনি ইরানে সর্বোচ্চ অনুসরণীয় ধর্মীয় ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন। কিন্তু ৪৯ বছর বয়সী সাইয়্যেদ আলি হোসেইনি খামেনি তখনো মারজা হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন না।
১৯৮৯ সালের ৪ জুনের নাটকীয় ঘটনা:
১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধ শেষ হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি এমনিতেই নানান সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। তারমধ্যে সর্বোচ্চ নেতার মৃত্যুতে বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়। নেতৃত্বশূন্যতা তৈরি হলে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বাইরের হস্তক্ষেপের আশঙ্কা ছিল। তাই দ্রুত নতুন সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করা জরুরি হয়ে ওঠে।
১৯৮৯ সালের ৩ জুন মারা যান ইরানের প্রথম সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনি। ৪ জুন জরুরি বৈঠকে বসে মাজলেসে খোবরেগান বা বিশেষজ্ঞ ধর্মীয় পরিষদ।
মাজলেসে খোবরেগান ৮৬ সদস্যের একটি পরিষদ। যাদের কাজ হলো সর্বোচ্চ নেতা মনোনয়ন ও পর্যবেক্ষণ। সেদিনের বৈঠকে উপস্থিতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। এদের মধ্যে একজন ছিলেন আকবর হাশেমি রাফসানজানি। তিনি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। পরবর্তীতে দেশটির প্রেসিডেন্টও হন। সভাটি তার নেতৃত্বেই বসেছিল।
ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাইয়্যেদ আলি হোসেইনি খামেনি। এক পর্যায়ে রাফসানজানি তাকে পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচিত করা প্রস্তাব দেন। কিন্তু তার এই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করেন খামেনি।
খামেনির বক্তব্য:
‘‘আমি স্পষ্ট করে বলছি—আমি এই দায়িত্বের যোগ্য নই। আমি কখনো ভাবিনি আমাকে এমন দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।’’
‘‘আমি নিজেই বিশ্বাস করি না একজন ‘মুজতাহিদে রাসেখ’ না হলে সর্বোচ্চ নেতা হওয়া উচিত।’’
‘‘আমি কোনোভাবে ইমাম খোমেইনির মতো ব্যক্তি হতে পারব না। এই জাতির জন্য এমন একজনকে দরকার যার ফিকহ (ইসলামী আইন) ও নেতৃত্বে পূর্ণ দখল আছে।’’
আপনারা যদি আজ আমাকে নেতা ঘোষণা করেন, কাল দেশব্যাপী লোকেরা বলে উঠবে— এই লোককে কোথা থেকে আনলে? সে তো মারজা-ই-তাকলিদও না! এই দায়িত্ব গ্রহণ করার মানসিক প্রস্তুতি বা যোগ্যতা আমার নেই।
ঐতিহাসিক ভিডিওতে তার কণ্ঠের কম্পন, দ্বিধা ও বিনয় স্পষ্ট ভাবে ফুটে ওঠে।
সভায় উপস্থিত অন্যদের বক্তব্য:
কেউ কেউ বলেন, ‘‘সংবিধান অনুযায়ী ‘মারজা’ হওয়া বাধ্যতামূলক। খামেনি তো এখনো মারজা নন।’’
অনেকে বলেন, ‘‘আমরা সংবিধান ভাঙতে পারি না। এটা ঠিক যে, খামেনি ভালো লোক কিন্তু তিনি সর্বোচ্চ নেতা হওয়ার শর্ত পূরণ করেন না।’’
তিনি সর্বোচ্চ নেতা হওয়ার মতো ধর্মীয়ভাবে যথেষ্ট উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন নন। তিনি খোমেইনির মতো ব্যতিক্রমী ধর্মীয় সম্মান পান না, তাই জনগণ তাকে সহজে গ্রহণ করবে না।
অন্যদিকে কেউ কেউ এমনও বলেন, দেশ এখন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন আমাদের ‘ফিকহি যোগ্য’ নয় বরং এমন নেতা দরকার যিনি রাজনৈতিকভাবে সক্ষম ও অভিজ্ঞ।
আরও পড়ুন: আগের ভিডিও শেয়ার করে যুক্তরাষ্ট্রকে যে হুঁশিয়ারি দিলেন খামেনি
তর্ক-বিতর্কের মাঝে আকবর হাশেমি রাফসানজানি বলেন,
আমার কাছে ইমাম খোমেইনির একটি ব্যক্তিগত কথা আছে। তিনি বলেছিলেন— ‘খামেনি উপযুক্ত। যদি আমি না থাকি, তাহলে তিনিই নেতৃত্ব দিতে পারবেন।’
‘‘আমরা এখন বিপদের মধ্যে আছি। আমাদের একজন সাহসী এবং অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা দরকার। এই মুহূর্তে খামেনি ছাড়া আর কে আছে?‘’
রাফসানজানি বুঝাতে চান, রুহুল্লাহ খোমেইনিও খামেনিকে যোগ্য মনে করতেন। তার এই বক্তব্য বৈঠকের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
যেহেতু সংবিধান অনুযায়ী খামেনির যোগ্যতা ছিলো না, তাই তাকে নতুন করে রেফারেন্ডাম না হওয়া পর্যন্ত এক বছরের জন্য “অস্থায়ী” সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে নির্বাচিত করার প্রস্তাব দেন রাফসানজানি।
অনেক আলোচনা ও মতভেদের মাঝে এক পর্যায়ে তিনি বলেন, আমরা বিতর্ক বাদ দিয়ে বরং ভোটাভুটি চলে যাই। এরপর তিনি বলেন, ‘খামেনির নেতৃত্বকে যারা সমর্থন করেন তারা দাঁড়িয়ে পড়ুন।’ এই বলে নিজে দাঁড়িয়ে পড়েন। এরপর অন্যরাও দাঁড়িয়ে সমর্থন জানান। ফলে আয়াতুল্লাহ খামেনি হন ইরানের অস্থায়ী সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা।
পরের মাসেই ইরানের সংবিধান পরিবর্তন করা হয়— যাতে সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে মারজা হবার শর্ত তুলে দেওয়া হয়। শুধু “ইসলামী ফিকহে দক্ষ” হলেই চলবে।
এরপর খামেনি স্থায়ীভাবে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে ঘোষণা পান। তখন তার বয়স ছিলো ৪৯ বছর। বর্তমানে তার বয়স প্রায় ৮৬। অর্থাৎ বিগত তিন যুগ ধরে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মী নেতা তথা সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি খামেনি।
১৯৮৯ সালে খামেনি স্থায়ীভাবে সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্ব নেন। আগস্টে তার রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর নির্বাচনের মাধ্যমে ইরানের চতুর্থ প্রেসিডেন্ট হন রাফসানজানি।