মার্কিন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, টিকটক নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে মার্কিন সরকারের আদেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে করা আপিলে হেরে গেছে টিকটকের মালিক চীনা কোম্পানি বাইটড্যান্স।
ফলে পূর্বঘোষিত তারিখ অনুযায়ী আগামী ১৯ জানুয়ারি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে কার্যকর হবে টিকটকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা। এই রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালত মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার কথা জানিয়েছে টিকটক কর্তৃপক্ষ।
তবে সুপ্রিম কোর্টেও যদি মার্কিন সরকারের টিকটক নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত বহাল থাকে তবে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নেয়া ছাড়া চীনা এই অ্যাপসের সামনে আর কোনো রাস্তা খোলা থাকবে না।
আরও পড়ুন: কেন বন্ধ হলো ‘ভারতের টুইটার’ কু?
গত এপ্রিল মাসে টিকটক নিষিদ্ধ সংক্রান্ত একটি বিলে স্বাক্ষর করেন বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। টিকটক কর্তৃপক্ষকে তাদের কোম্পানিকে চীনের বাইরের কোনো কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয়ার অথবা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার শিকার হওয়ার শর্ত বেঁধে দেয়া হয়।
এই সিদ্ধান্তকে স্থগিত করতে মার্কিন আদালতে আবেদন করে টিকটকের মালিক বাইটড্যান্স। গত শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) বাইটড্যান্সের এই আবেদন প্রত্যাখ্যান করে যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার সার্কিট কোর্ট।
কেন টিকটকের ওপর খড়গহস্ত মার্কিন কর্তৃপক্ষ?
টিকটকের মতো নিরীহ বিনোদনমূলক একটি অ্যাপসের ওপর মার্কিন কর্তৃপক্ষ কেন খড়গহস্ত, সে বিষয়টির তত্ত্বতালাশ করতে গেলে সামনে চলে আসে সামরিক ও অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের চলমান দ্বৈরথের বিষয়টি।
টিকটক নিষিদ্ধ করার পেছনে সবচেয়ে বড় যে যুক্তি তুলে ধরছে মার্কিন প্রশাসন তার মধ্যে অন্যতম হলো যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু। অর্থাৎ আপাত নিরীহ অ্যাপস টিকটকে নিজেদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছে দেশটি।
ওয়াশিংটনের দাবি, মার্কিন ব্যবহারকারীদের ফোনে ডাউনলোড হওয়া টিকটক অ্যাপসের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন তথ্য ফাঁস এবং পাচার হচ্ছে। বিশেষ করে তাদের সন্দেহের তীর সরাসরি বিদ্ধ করছে বেইজিং প্রশাসনকে।
এ ব্যাপারে হোয়াইট হাউজ সামনে আনছে চীনা কর্তৃপক্ষের একটি আইনকে, যে আইন বলে বেইজিংয়ের কর্তৃপক্ষ তাদের দেশের যে কোনো ব্যক্তি বা সরকারি এবং বেসরকারি কোম্পানির ব্যবহৃত তথ্য তলব করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্বেগের জায়গাটিই হলো এই আইন।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র টিকটকের মাধ্যমে নিজেদের দেশের তথ্য চীনা কর্তৃপক্ষের কাছে ফাঁস হওয়ার উদ্বেগ প্রকাশ করলেও ওয়াশিংটন এখন পর্যন্ত এমন কোনো তথ্য হাজির করতে পারেনি, যেখানে প্রমাণিত হয় টিকটকের মাধ্যমে গোপনে মার্কিনিদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করছে বেইজিং।
টিকটকের বিরুদ্ধে ‘মগজধোলাই’র অভিযোগ
তবে টিকটক নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের পেছনে শুধু নিরাপত্তা উদ্বেগই কাজ করছে না, বরং যুক্তরাষ্ট্রের কারও কারও মতে, টিকটকের মাধ্যমে মার্কিন তরুণ প্রজন্মের ‘ব্রেনওয়াশ’ তথা মগজধোলাই করছে চীন। এমনকি টিকটক চীনের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির প্রোপাগান্ডার অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবেও মনে করেন মার্কিন অনেক আইনপ্রণেতা।
আরও পড়ুন: চীনের ধনী ব্যক্তির তালিকায় শীর্ষে টিকটকের প্রতিষ্ঠাতা ঝাং
তারা মনে করেন, টিকটকের মাধ্যমে কোটি কোটি মার্কিন তরুণের মন ও মগজকে চীনের পক্ষে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে বেইজিং। এ ব্যাপারে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে মার্কিন রিপাবলিকান দল থেকে নির্বাচিত সিনেটর জিম রিচের নাম।
টিকটকের কঠোর সমালোচক হিসেবে পরিচিত এই মার্কিন আইনপ্রণেতা চীনা এই অ্যাপসকে উল্লেখ করেছেন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি একটি মাধ্যম, যার উদ্দেশ্য মার্কিন তরুণ প্রজন্ম ও শিশু কিশোরদের মনকে দূষিত করা।
এদিকে বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাঘা বাঘা প্রযুক্তি কোম্পানি এবং তাদের তৈরি নানা রকম অ্যাপসকে পেছনে ফেলে কীভাবে চীনের অখ্যাত একটি কোম্পানির তৈরি অ্যাপস মার্কিনিদের মধ্যে এত জনপ্রিয় হলো তা নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের আলোচনা।
তবে বিশেষজ্ঞরা এ জন্য কৃতিত্ব দিচ্ছেন টিকটকের উন্নত অ্যালগরিদম এবং ব্যবহারকারীদের চাহিদা বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে টিকটকের প্যারেন্টস কোম্পানি বাইটড্যান্সের প্রযুক্তিবিদ ও প্রকৌশলীদের দক্ষতাকে।
বিশেষ করে মূলত উন্নত অ্যালগরিদমের জোরেই প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন কোম্পানিগুলোর তৈরি করা অ্যাপসকে টেক্কা দিচ্ছে টিকটক এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যবহারকারীদের বয়স ও তাদের চাহিদা অনুযায়ী কনটেন্ট তৈরি এবং ব্যবহারকারীদের টিকটক প্ল্যাটফর্মে আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে বাইটড্যান্সের দক্ষতা।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাব
এছাড়া টিকটক নিষিদ্ধ করতে মার্কিন আইন প্রণেতাদের এই অতি উৎসাহী মনোভাবের পেছনে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং ভূরাজনৈতিক ঘটনাবলীরও প্রভাব থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এক্ষেত্রে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে ফিলিস্তিনের গাজায় দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর নৃশংস সামরিক অভিযান। টিকটকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে এই প্ল্যাটফর্ম গাজায় ইসরায়েলি নৃশংসতার বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে তৈরি হওয়া সেন্টিমেন্ট এবং অ্যাক্টিভিজমকে উৎসাহিত করছে।
আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ!
অপরদিকে টিকটকের অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ফেসবুকের প্যারেন্টস কোম্পানি মেটার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে ইসরাইলপন্থি কনটেন্টকে অধিক হারে উৎসাহিত করার। এক জরিপে দেখা গেছে, টিকটকে ইসরাইলপন্থি কনটেন্টের বিপরীতে ফিলিস্তিনপন্থি কনটেন্টের পরিমাণ বেশি।
সমালোচকরা বলছেন, মূলত এই কারণেই টিকটক নিষিদ্ধ করার পেছনে নিজেদের দলীয় ভেদাভেদ ভুলে এক প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী উভয় রাজনৈতিক দলের ইসরাইলের প্রতি সহানুভূতিশীল আইনপ্রণেতারা।
দুই দেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের টিকটিক নিষিদ্ধ করার এই উদ্যোগের প্রতিক্রিয়া শুধু টিকটকের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং তা অনুভূত হবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অন্যান্য ক্ষেত্রেও।
বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ হলে তা দেশটিতে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে চীনের অন্যান্য প্রযুক্তি কোম্পানির অনিশ্চয়তাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে প্রযুক্তির দুনিয়া চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে।
এছাড়া টিকটক নিষিদ্ধের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের ওপর নির্ভরশীল অনেক ব্যক্তি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হতে পারে। এমনকি কর্মসংস্থান হারাতে পারেন বহু মার্কিন নাগরিক। পাশাপাশি এর প্রভাবে বিপুল পরিমাণ বাজার মূল্য হারাতে হতে পারে টিকটকের প্যারেন্টস কোম্পানি বাইটড্যান্সকে।
আরও পড়ুন: টেলিগ্রাম ব্যবহার নিষিদ্ধ করল ইউক্রেন
এদিকে মার্কিন আদালতে টিকটিক কর্তৃপক্ষের আপিল গ্রহণযোগ্য না হলেও এখনও যুক্তরাষ্ট্রে চীনা এই অ্যাপসটির টিকে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন। মার্কিন কংগ্রেসে পাস করা যে বিলে টিকটক নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হয়েছে সেখানে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে এককালীন সুযোগ দেয়া হয়েছে এই নিষেধাজ্ঞাকে ৩০ দিন পিছিয়ে দেয়ার।
ফলে ইচ্ছে করলে বাইডেন এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের সময়সীমা আরও ৩০ দিন পিছিয়েও দিতে পারেন, অবশ্য বাইডেন তা করবেন কি না সে বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়।
পাশাপাশি এ ধরনের কোনো পরিকল্পনার ইঙ্গিতও বাইডেন কিংবা হোয়াইট হাউজের বর্তমান প্রশাসনের তরফে এখনও দেয়া হয়নি। তবে বাইডেন না চাইলেও টিকটককে উদ্ধার করার সুযোগ রয়েছে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে। টিকটক যেদিন থেকে নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে ঠিক তার পরেরদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে হোয়াইট হাউজের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন তিনি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প কট্টর চীনবিরোধী হলেও চীনের এই অ্যাপসটির ব্যাপারে তার বিশেষ সহানুভূতি রয়েছে। কারণ নির্বাচনী প্রচারণার সময় তরুণ প্রজন্মের কাছে ডেমোক্রাট শিবিরের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারণা টিমের অন্যতম মাধ্যম ছিল এই টিকটক। এমনকি গত জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন তিনি কখনই টিকটক নিষিদ্ধ করবেন না।
আরও পড়ুন: স্বাভাবিক হলো ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ
টিকটক নিষিদ্ধের উদ্যোগ ঠেকাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত বিল বাতিল করার পরামর্শ দিতে পারেন মার্কিন আইন প্রণেতাদের। তবে কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের এই পরামর্শে সাড়া দেবে তার সম্ভাবনা খুবই কম। কংগ্রেস তার কথা না শুনলে ট্রাম্প তার মনোনীত অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দিতে পারেন এই আইনকে কার্যকর না করার ব্যাপারে।
তবে নিউইয়র্ক টাইমসের মতে টিকটককে বাঁচাতে ট্রাম্পের এই উদ্যোগ ভালোভাবে নেবে না টিকটকের প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যান্য মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো। তাদের হিসেবটাও সহজ। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই টিকটকের ১৭ কোটি ব্যবহারকারী রয়েছেন। তাই টিকটক নিষিদ্ধ হলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে এই মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোই।
]]>