অনুসন্ধান বলছে, অন্তত সাতটি গ্রুপের নেতৃত্ব ছাড়াও দূর দূরান্তের অনেকের সম্পৃক্ততায় দিনে রাতে সবার চোখের সামনে খেয়ে ফেলা হয় কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথর এলাকা ও নিকটবর্তী রেলওয়ে বাঙ্কারসহ একাধিক স্থানের হাজার কোটি টাকার বিপুল পরিমাণ পাথর। যদিও এখন কেউ লাপাত্তা আবার কেউবা দায় এড়িয়ে কুলুপ এঁটেছেন মুখে।
সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, সরকারের নজরে পড়া এই পাথরকাণ্ডে শাস্তিমূলক প্রত্যাহার (ওএসডি) হয়েছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ, বদলি করা হয়েছে অভিযুক্ত কোম্পানিগঞ্জের ইউএনও আজিজুন্নাহারকে। এছাড়া দুটি আলাদা মামলায় এখন পর্যন্ত ১২ জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
খবরের বিস্তারিত
গত বছরের ১৩ অক্টোবর। ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর এলাকা থেকে রাতের অন্ধকারে অবাধে পাথর লুটপাটকারী চক্রের তাণ্ডব তুলে ধরে বিশেষ প্রতিবেদন প্রচার করে সময় সংবাদ। সেসময় কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের আলম ও তৎকালীন ইউএনও আবিদা সুলতানা এসব পাথর লুট বন্ধে অভিযানের আশ্বাস দেন। সংবাদ প্রচারের পরদিনই প্রশাসনের অভিযানে দুই শতাধিক নৌকা ধ্বংস করা হয়। কিন্তু আবারো চলতে থাকে এই লুটপাট, ধ্বংসস্তূপে রূপ নেয় এসব এলাকা।
সময় সংবাদে প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদনের ১০ মাস পরের অবস্থা নিয়ে সারাদেশে সৃষ্টি হয়েছে তোলপাড়। এক সময়ের নয়নাভিরাম সাদাপাথর পর্যটন এলাকা থেকে লুটে নেয়া হয়েছে প্রায় দেড় কোটি ঘনফুটের বেশি পাথর। প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে গোটা দেশ। ফলে লুটের পাথর ফিরিয়ে এনে পূর্বের অবস্থায় নেবার চেষ্টা চলছে। যদিও প্রশাসনের এমন তৎপরতাকে তামাশা বলে আখ্যা দিচ্ছেন স্থানীয়রা।
আরও পড়ুন: ভোলাগঞ্জ কি আগের রূপে ফিরবে?
নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ফটোগ্রাফার ও ক্ষুদ্র ব্যবসাসায়ী জানান, দিনরাত পাথর লুট চলে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের পরিবারের অনেককেই সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি অন্য দলের নেতাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে লুটপাটে গতি এনেছিলেন। স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধিও অংশ নেন তাদের সঙ্গে। সবাই মিলে লুটে নেন পাথর, কেউ কেউ নৌকা থেকে হাতিয়েছেন টাকা। গর্ত খুঁড়ে, জায়গা ভাড়া দিয়ে কিংবা জায়গা দখল করে পাথর উত্তোলনে আয় করেছেন বিপুল অর্থ। এ সময় প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও লুটকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহ করেন স্থানীয়রা।
সময় সংবাদের অনুসন্ধান
অনেকটা সিনেমার গল্পের মতো শোনালেও সময় সংবাদের অনুসন্ধান বলছে, দেশ বিদেশে আলোচনার তুঙ্গে থাকা সিলেটের সাদাপাথর পর্যটন এলাকার তোলপাড় করা ঘটনাটি একটি পরিকল্পিত ও সমন্বিত সংগঠিত অপরাধ। স্থানীয় প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তা কর্মচারী ও রাজনৈতিক নেতাদের যোগশাজসে এই লুটপাট পেয়েছিল অঘোষিত বৈধতা।
লুটপাট চলাকালে স্থানীয় জনতার হাতে আটক কিছু নৌকা শ্রমিকদের ভিডিও বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে আটক নৌকা শ্রমিকরা দাবি করেন, স্থানীয় বিজিবির কতিপয় সদস্যদের প্রতি নৌকায় পাথর লুটের কাজে ৫০০ টাকা করে দিতে হয়েছে। যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেন বাহিনীটির দায়িত্বশীল পর্যায়ের কর্মকর্তা। তিনি জানান, চোরাই পাথরের নৌকা ধরতে গেলে একটি চক্র বিজিবিকে মব সৃষ্টি করে অপবাদ দেয়ার চেষ্টা করে।
অন্যদিকে, লুটপাট চলাকালে কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশের ভূমিকা নিয়েও ওঠে নানা প্রশ্ন। কোম্পানীগঞ্জ থানা বাজার এলাকার এক বাসিন্দা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ‘লুটপাটের বালু পাথর ধরতে কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশকে জানালে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ওসি সাহেব ওই এলাকায় অভিযান দিতে নিষেধ করেছেন’।
আরও পড়ুন: পাথরকাণ্ডে কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও বদলি
শুধু ওই বাসিন্দা নন, আরো অনেকেই ওসির সঙ্গে লুটপাটকারী চক্রের অবৈধ টাকা লেনদেনের অভিযোগ করেন। যদিও সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওসি উজায়ের আলম।
গেল বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের শেষ দিন পর্যন্ত দিনে রাতে সাদাপাথরের নিকটবর্তী রেলওয়ে বাঙ্কার এলাকা থেকে লুট হয় পাথর। এরপর সাদাপাথর পর্যটন স্পটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে লুটেরা চক্র।
একই নামে দুজনের খোঁজ
এই লুটপাটে আলোচনায় আসেন ধলাই নদের দুই তীরের দুই সাহাবুদ্দিনের নাম। নামের মিলের পাশাপাশি অবাক করা বিষয় হলো দুই সাহাবুদ্দিনের বাবার নামও একই! দুজনের বাবার নামই আব্দুল বারি, যদিও অমিল কেবল রাজনীতিতে। একজন বিএনপি এবং অন্যজন আওয়ামী লীগ নেতা।
দুই সাহাবুদ্দিন ছাড়াও স্থানীয় আলফু চেয়ারম্যানসহ অন্তত সাতটি গ্রুপের বিরুদ্ধে রয়েছে পাথর চুরি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্থানীয় বাসিন্দার অভিযোগ, আলাদা আলাদা দলের লোক হলেও পাথর চুরিতে একজোট হয়েছিলেন ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শী মানুষ। সবাই মিলেই গড়ে তোলেন প্রভাবশালী লুটেরা চক্র, যাদের ভয়ে কথা বলতেও ছিল ভয়। দূর দূরান্তের লোকরাও এই লুটপাটে নানাভাবে অংশ নেন। তবে প্রশাসন চাইলেই বন্ধ করতে পারতো এই লুটপাট।
ফলাফল
কয়েকমাসে রেলওয়ে বাঙ্কার এলাকা পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। সাদাপাথর পর্যটন এলাকার প্রায় ৫০ শতাংশ পাথরই গায়েব করে দেয় লুটেরা চক্র। লুটপাট যখন শতভাগ সফল তখন টনক নড়ে সবারই। দলীয় পদ স্থগিত হয় কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সেই সাহাবউদ্দিনের। অভিযানে নামে জেলা প্রশাসন ও যৌথবাহিনী, তল্লাশি চলে পাথরবাহী ট্রাকগুলোতেও।
চোরাই পাথর পরিবহনে চুক্তি যেভাবে
কোম্পানীগঞ্জ সাদা পাথর থেকে পাথর সরিয়ে বিভিন্ন জায়গায় স্তূপ করে রাখতো চক্রটি, পরে কেউ কেউ স্থানীয় পাথরভাঙা কলে বিক্রি করতেন। কেউবা আস্ত পাথরই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করে দিতেন। এসব পাথর পরিবহনে ট্রাকের সঙ্গে চুক্তি করতে হতো। ট্রাকের সঙ্গে চুরি হওয়া পাথর পরিবহণে কীভাবে চুক্তি হয়েছিল, তা জানার চেষ্টা করে সময় সংবাদ।
ধুপাকুল এলাকায় সড়কে পাথর বোঝাই দুটি ট্রাকের চালক জানান, পার্টি যোগাযোগ করতো ট্রান্সপোর্টের সঙ্গে। সেখানে পার্টি জানিয়ে দেয় পাথর কোন এলাকায় রাখা রয়েছে। দূরত্ব বিবেচনা করে ও মালামালের পরিমাণ হিসাব করেই ট্রাক ভাড়ার টাকার অঙ্ক নির্ধারণ করা হতো। পরে পার্টি নিজস্ব লোক দিয়ে ট্রাকবোঝাই করে দিতো চোরাই পাথর। এসব ক্ষেত্রে আমদানি করা পাথর বুঝাতে দেশীয় উত্তোলন নিষিদ্ধ পাথর মেশিনে ভাঙিয়েও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানোর কাজ করতো চক্রের সদস্যরা।
অভিযান ও চক্রের পলায়ন
সাদাপাথর পর্যটন এলাকায় হরিলুটের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর সারা দেশের সচেতন মানুষের প্রতিবাদের মুখে সরব হয়ে ওঠে স্থানীয় প্রশাসন, শুরু হয় অভিযান। এরপরই গা ঢাকা দেন লুটপাটে অংশ নেয়ায় অভিযুক্ত সব গ্রুপের নেতারাই। ভারতে পালিয়ে যাওয়ার গুঞ্জন ওঠে বিএনপি নেতা সাহাবুদ্দিনের। আবার লাপাত্তা আওয়ামী লীগের সাহাবুদ্দিনও। টানা তিনদিন চেষ্টার পর খোঁজ মেলে গা ঢাকা দেয়া বিএনপির পদ স্থগিত নেতা সাহাবুদ্দিনের। নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন তিনি। একইভাবে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন আওয়ামী লীগের সাহাবুদ্দিনও।’
বিএনপি নেতা সাহাবুদ্দিন সময় সংবাদ কে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি লুটপাটের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম, বার বার প্রশাসনকে আমরা বলেছি অভিযান দেন, তারা নিরব ভূমিকায় ছিল। দেখছি দেখছি করে সব লুটপাট হয়ে গেছে। আমরা এসবের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছি। এখন আমাকেই বলা হচ্ছে আমি নাকি এসব করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার নামে আরেক সাহাবুদ্দিন আছেন নদীর ওপর তীরের বাসিন্দা। তার বাবার নামও একই। অন্যরা এসব করেছে। এখন দোষ চাপানে হচ্ছে সব আমার দিকে।’
কিন্তু ঘটনার কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন ধলাই নদের ওপর প্রান্তের বাসিন্দা আওয়ামী লীগ নেতা সাহাবুদ্দিন। তিনি সময় সংবাদকে বলেন, ‘অন্যরা এসব লুটে খেয়েছে। আমি এসবের সঙ্গে জড়িত নই। সবাই গিয়ে দলবেঁধে পাথর এনেছে। বহু শ্রমিক এই লুটপাট করেছে। এখন একদল আরেক দলের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলছে।’
এদিকে, অভিযুক্ত আলফু চেয়ারম্যানের খোঁজে তার থানা বাজার এলাকার ভাড়া বাসায় গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি, তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তার স্বজনরা।
আলফু চেয়ারম্যানের মামাতো ভাই পরিচয় দেয়া আকদ্দুস আলী নামের এক ব্যক্তি সময় সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের পরিবারের কেউ পাথরচুরির সঙ্গে জড়িত নন। লুটপাট করেছে কয়েকটি গ্রুপ।’
স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) উপস্থিতিতেই পাথর লুটপাটের অভিযোগ ওঠে, সময় সংবাদের হাতেও আসে এমন একটি ভিডিও। স্থানীয়দের অভিযোগ পাথর লুটের টাকার ভাগ পেতেন উপজেলা প্রশাসনের এই সর্বোচ্চ কর্মকর্তাও। পাথরকাণ্ডে তোলপাড় শুরু হলে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিতে আবার ওই অভিযুক্ত ইউএনওকে রাখা হয়, এতে ক্ষুব্ধ হন স্থানীয়রা।
তদন্তের মেয়াদকাল শেষ হলেও এই কমিটি কোনো প্রতিবেদন না দিয়ে উল্টো সময় চায়, এতে সৃষ্টি হয় আলোচনা সমালোচনার। যদিও পাথরকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন সদ্য বদলি হওয়া ইউএনও আজিজুন্নাহার।
সময় সংবাদকে তিনি বলেন, ‘আমি জড়িত থাকা বা টাকা নেয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমরা যদি জড়িত থাকি তাহলে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমার জড়িত থাকার অভিযোগ বানোয়াট।
লুটপাটে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে পুলিশ-বিজিবিও। কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান বলেন, ‘আমি জড়িত থাকার কথা যে বলবে তাকে সামনে আনেন, জবাই করে ফেলবো সে যদি বলতে পারে যে আমি টাকা নিসি। পুলিশের কেউ পাথর থেকে টাকা নেয়নি।’
স্থানীয় অীভযোগ, ‘এই ওসির কার্যালয়ের সামনে দিয়েই প্রতিদিন দিনে রাতে লুট হওয়া পাথর ও বালু শত শত নৌকায় করে নিয়ে যেতো লুটেরা চক্র। থানার ঘাটেই বাঁধা থাকতো অনেক বালু ও পাথরবাহী নৌকা।’ ডিসি ও ইউএনওর বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিলেও এখনো বহাল তবিয়তে থানার ওসি উজায়ের আলম।
৪৮ বিজিবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাজমুল হক সময় সংবাদকে বলেন, ‘বিজিবির কোনো সদস্য জড়িত থাকার প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের সদস্যরা লুটপাটকারীদের প্রতিনিয়ত ধাওয়া দিয়েছে। অনেক অভিযান পরিচালনা করে বহু সংখ্যক নৌকা আমরা ধরেছি। বিজিবির কারণেই এখনো সাদাপাথরের মূল স্পটে পাথর রয়েছে। যারা টাকা নেয়ার অভিযোগ তুলেছে, তারা একটি চক্রের সদস্য। যারা বিজিবি নৌকা আটকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের ব্যপারে আমরা বিজিবির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটেও সার্বিক ব্যপারে স্পস্ট বার্তা দিয়েছিলাম।’
সদ্য ওএসডি হওয়া সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ বলেন, ‘লুটপাটে আমাদের প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা জড়িত থাকলেও তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
প্রসঙ্গ: ব্যাপক হরিলুটের পর পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার খবরে চলতি বছরের জুনে জাফলং পরিদর্শনে এসে পাথর কোয়ারি খুলে না দেয়ার কথা বলায় দুই উপদেষ্টার গাড়ি বহর আটকে বিক্ষোভ করে পাথর উত্তোলনে সম্পৃক্ত চক্র। বিক্ষোভের মুখে সাদাপাথর এলাকা পরিদর্শন না করেই ঢাকায় ফিরে যেতে হয়েছিল দুই উপদেষ্টাকে।
]]>