সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী শনিবার ১৪ জুন পর্যন্ত পর্যটকের চাপ রয়েছে। দিন যত যাচ্ছে পর্যটকও বাড়ছে।
ভ্রমণে আসা এসব পর্যটকের কাছে উপেক্ষিত হয়েছে রোদ, বৃষ্টি এবং উত্তাল সাগর। কখনো তীব্র রোদে আবার কখনো বৃষ্টিতে ভেজে উত্তাল সাগরের ঢেউর তালে শরীর ভাসিয়েছে এসব পর্যটক। আর এতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। স্রোতের কবলে প্রাণ হারিয়েছে ৪ জন।
মঙ্গলবার দিনটি ছিল কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি। আর এর মধ্যে উত্তাল সাগরের নোনাজলে মাতোয়ারা লাখো পর্যটক। ঈদের লম্বা ছুটির ৪র্থ দিনে বাঁধ ভাঙা আনন্দ-উচ্ছ্বাসে কাটছে তাদের প্রতিটি মুহূর্ত।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সব পয়েন্টে বাড়তে থাকে সৈকতে পর্যটকের আগমন। বেলা ১২ বাজতেই কলাতলী থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় ৩ কিলোমিটার সাগরতীর জুড়ে লাখের বেশি পর্যটকের অবস্থান দেখা গেছে।। কখনো ঝুম বৃষ্টি, কখনো রোদ কিংবা মেঘলা আকাশ। যা পর্যটকের আনন্দের মাত্রা বাড়িয়েছে বহুগুণে। নোনাজলে মেতে ওঠার পাশাপাশি বালুচরে মেতেছেন ছবি তোলা কিংবা বালু নিয়ে খেলায়।
মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা পর্যটক আজাদ রহমান (৬০) বলেন, অন্যান্য বছরের চেয়ে এবছর ঈদ আনন্দ অন্যভাবে উপভোগ করছি। জীবনে নাতি ছাড়া কেউ কক্সবাজারে আসবেন না। অবশ্যই একবার নাতি নিয়ে কক্সবাজার এসে ঘোড়ার পিঠে চড়বেন, দেখবেন নিজেও ছোটবেলায় ফিরে যাবেন।
আরও পড়ুন: রোদ-বৃষ্টি আর উত্তাল সাগরের সৌন্দর্যে মাতোয়ারা লাখো পর্যটক
ঢাকা থেকে আসা পর্যটক মনিকা বলেন, ‘এমনিতেই কর্মক্ষেত্রে ছুটি পাওয়া হয় না। তাই ইচ্ছে থাকলেও কক্সবাজারে ছুটে আসা যায় না। কিন্তু এবার ঈদের ছুটিটা অনেক বেশি, বলা যায় ১০ দিন। তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে ছুটে আসা। সৈকতে যতই মানুষ বাড়ে ততই আনন্দ লাগে।’
আরেক পর্যটক এস এম ইব্রাহীম বলেন, ‘কক্সবাজার এমন স্থান যেখানে বার বার আসলেও মনে হয় বার বার আসি। ঈদের ছুটিতে কক্সবাজার আসলাম। এখানে জেড স্কী, বিচ বাইক, ঘোড়া পিঠে উঠে ছবি তুলেছি। খুবই আনন্দ হচ্ছে। মূলত কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে আসলে গায়ে যে বাতাস লাগে তাতে মন জুড়িয়ে যায়।’
আরেক পর্যটক রুবিনা আলম বলেন, ‘ঈদের ছুটি কাটানোর উপযুক্ত স্থান হচ্ছে কক্সবাজার। তাই পরিবার নিয়ে কক্সবাজার এসেছি। এখানে মেরিন ড্রাইভ, হিমছড়ি, ইনানী ও পাতুয়ারটেক খুবই সুন্দর লাগে।’
শফিক রহমান বলেন, ‘ঈদ হচ্ছে আনন্দ আর ত্যাগের। ঈদ আনন্দটা আরো বেড়ে যায় যখন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে আসি। এখানে আবহাওয়া অনেক ভালো। কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি; তখন আনন্দের মাত্রাটা আরও বেড়ে গেছে।’
সুমাইয়া ইয়াছমিন বলেন, ‘ঈদের ছুটি কাটানোর জন্য কক্সবাজার ছুটে আসা। খুবই আনন্দ করছি। তবে এত মানুষ কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ভিড় করেছে, যার কারণে সমুদ্রও ভালোভাবে উপভোগ করা যাচ্ছে না। রোদ, বৃষ্টির কক্সবাজার খুবই ভালো লাগছে।’
কক্সবাজার আবাসিক হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার জানিয়েছেন, ঈদের প্রথমদিন পর্যটক উপস্থিতি তেমনটা ছিল না। দ্বিতীয়দিন থেকে পর্যটক সমাগম বাড়তে শুরু করেছে। এতে সাড়ে ৫ শতাধিক হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টের ৫০ শতাংশের কক্ষ বুকিং রয়েছে। সোমবার থেকে শতভাগ বুকিং রয়েছে। এটা রোববার পর্যন্ত থাকবে।
তার দেয়া তথ্য মতে, গত ৪ দিনে কক্সবাজারে প্রায় ৪ লাখের কম-বেশি পর্যটক ভ্রমণে এসেছেন। আগামি ৪ দিন আরও ৪ লাখ পর্যটক ভ্রমণের আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
আরও পড়ুন: পর্যটকদের পদচারণায় মুখর রাঙ্গামাটি
যদিও সাগর উত্তাল। কয়েকটি পয়েন্টে সৃষ্টি হয়েছে গর্ত। আবার রয়েছে উল্টো স্রোতের টান। যার কারণে পর্যটকদের সমুদ্রস্নানে নিরাপত্তায় সতর্ক রয়েছে লাইফ গার্ড সংস্থার কর্মীরা। উত্তাল সাগর ও সৃষ্ট গর্তে কক্সবাজারে সাগরে গোসলে নেমে পর্যটক বাবা-ছেলেসহ দুইদিনে চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
এর মধ্যে সোমবার দুপুর দেড়টার দিকে কক্সবাজার সৈকতের কলাতলী পয়েন্ট সাগরে রাজশাহী সদরের শাহীনুর রহমান (৬০) ও তার ছেলে মোহাম্মদ সিফাত (২০) ভেসে যেতে থাকা। পরে তাদের উদ্ধার করা হলেও হাসপাতালে নেয়া হলে তাদের মৃত্যু হয়।
এর আগে রোববার বিকেল সৈকতের লাবণী পয়েন্টে গোসলে নেমে চট্টগ্রাম শহরের ডিসি রোডের বাসিন্দা রাজীব আহম্মদ (৩৫) নামের এক পর্যটক নিখোঁজ হন। পরে ৮ ঘন্টা পর মধ্যরাতে সৈকতের ডায়াবেটিক পয়েন্টের উত্তর পাশ এলাকায় তার মৃতদেহ ভেসে আসে। এছাড়া রোববার সকালে সৈকতের শৈবাল পয়েন্টে জাল নিয়ে শখের বশে সাগরে মাছ ধরতে নেমে নিখোঁজ হন কক্সবাজার শহরের বাহারছড়া এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ নুরু নামের এক ব্যক্তি।
সোমবার সকালে বাঁকখালী নদীর মোহনা সংলগ্ন নাজিরারটেক পয়েন্ট সাগরে তার মৃতদেহ ভেসে আসে। পরে লাইফগার্ড কর্মীরা মৃতদেহটি উদ্ধার করেছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাফিস ইনতেসার নাফি এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দায়িত্বপালনকারি সী সেফ লাইফ সংস্থার সিনিয়র লাইফগার্ড কর্মী মোহাম্মদ শুক্কুর বলেন, সৈকতে ৩ স্তরের দায়িত্ব পালন করছে লাইফ গার্ড কর্মীরা। লাইফগার্ড কমীরা টাওয়ার থেকে পর্যবেক্ষক, বালিয়াড়িতে টহল ও বোট নিয়ে পানিতে অবস্থান করছে। কিন্তু পর্যটকদের সচেতন হতে হবে বেশি। তাদেরকে লাইফগার্ড কর্মীদের নির্দেশনা মানতে হবে, তা না হলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তারপরও লাইফগার্ড কর্মীরা সজাগ রয়েছে।
ট্যুরিষ্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের সহকারী পুলিশ সুপার নিত্যানন্দ দাশ বলেন, ঈদের ছুটিতে পর্যটকদের ভ্রমণকে আনন্দমুখর করতে তিনস্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে পর্যবেক্ষণের পাশপাশি সৈকতের প্রতিটি গোলঘরে পুলিশ অবস্থান করছে। একদিকে মোবাইল টিম অন্যদিকে সাদা পোশাকে পুলিশ সমুদ্র সৈকতে ঘুরছেন।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাফিস ইনতেসার নাফি বলেন, ঈদের ছুটিতে একাধিক মোবাইল টিম পর্যটকদের সকল ধরনের হয়রানি রোধে মাঠে কাজ করছে।
এদিকে শুধু কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত নয়, আগত পর্যটকরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনিন্দ্য সুন্দর মেরিন ড্রাইভ, হিমছড়ি ঝর্ণা, ইনানী ও পাটুয়ারটেকের পাথুরে সৈকত, রামুর বৌদ্ধ বিহার, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, শহরের বার্মিজ মার্কেট, রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড এবং ডুলাহাজার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কসহ জেলার বিনোদন কেন্দ্রগুলো।