রাজাধানী ঢাকার আরজাবাদ মাদরাসায় ২৪ জানুয়ারি শুক্রবার এ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে দারুল উলুম দেওবন্দের এ খ্যাতিমান উস্তাদ বলেন, দারুল উলুম দেওবন্দ, এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হজরত নানুতবী রহ. আর দেওবন্দের একদল বিশিষ্ট বুজুর্গ ব্যক্তি। তাদের মধ্যে ছিলেন হজরত সাইয়েদ হাজি আবেদ হোসাইন, হজরত শায়খুল হিন্দ রহ.-এর পিতা মাওলানা যুলফিকার আলী সাহেব। হজরত নানুতবী রহ.-এর যে ইলমী মর্যাদা ছিল, তা কারও ছিল না। তিনিই প্রথমে দেওবন্দে শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
দেওবন্দের ওলামায়ে কেরাম পূর্বসূরিদের অনুসৃত পন্থাকে গ্রহণ করেছিলেন। তবে তাদের কাজ কেবল মাদরাসার চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা শুধু পাঠদানেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। যেখানে ইসলামকে রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন পড়েছে, সেখানে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। বিদআতের প্রতিবাদে তারা মুখ খুলেছেন। মানুষ তাদের কাফের বলেছে, কিন্তু তারা কাউকে কাফের বলেননি। দেশকে স্বাধীন করার প্রয়োজন হলে ইংরেজদের জেলে পর্যন্ত তাঁরা গিয়েছেন। যে কোনো প্রয়োজনে তাঁরা ইসলামকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করেছেন।
তাদের এ সংগ্রামের ইতিহাস শুধু এক-দু দিনের নয়, এটি প্রায় ১৫০ বছরের ইতিহাস ১৮৬৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত। এই ইতিহাসে রয়েছে তাদের ত্যাগ ও কুরবানির কথা। তবে সাধারণত এই সব ইতিহাস উর্দু ভাষায় লিখিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে দেওবন্দের ওলামায়ে কেরামের বড় একটি পরিমণ্ডল রয়েছে, যারা হয়ত দেওবন্দে গেছেন বা দেওবন্দের ছাত্রদের থেকে জ্ঞান অর্জন করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ দেওবন্দের প্রকৃত ইতিহাস জানে না।
আরও পড়ুন: তাবলিগ জামাতের তালিমে যে বইটি পাঠ করা হয়
অনেকের ধারণা, দেওবন্দের ইতিহাস কেবল মাদরাসার মধ্যে পাঠদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। যদি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনকে দেখা হয়, তবে দেখা যাবে তিনি শুধু শিক্ষকই ছিলেন না। তিনি কুরআন-হাদিসের জ্ঞান প্রচার করেছেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রেও নেতৃত্ব দিয়েছেন।
এই ইতিহাস উর্দুতে লেখা ছিল। তাই দেওবন্দ মাদরাসার পক্ষ থেকে এটি বাংলায় অনুবাদ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়, যাতে দেওবন্দের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই ইতিহাস জানতে পারেন।
মাওলানা বাহাউদ্দীনকে আমি এ গ্রন্থের একটি কপি এনে দিয়েছি। তিনি এই বইয়ের অনুবাদ করিয়েছেন। আল্লাহ তাকে আর অনুবাদকদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করুন এবং তাদের এই খেদমত কবুল করুন।
এখন এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে, এখানে আমার সামনে রয়েছে। আমি এক-দুটি কপি দেওবন্দে নিয়ে গিয়ে মুহতামিম সাহেবকে দিয়ে দিব। বিশ-পঞ্চাশটি কপি আপনারা দেওবন্দে পাঠিয়ে দিবেন। পশ্চিম বঙ্গের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সারা বিশ্ব থেকে মেহমানরা সেখানে এসে থাকেন। তাঁরা এই বইয়ের মাধ্যমে দেওবন্দের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেন।
আপনারা সবাই এই বইটি পড়ুন। দেওবন্দের ইতিহাস এবং আমাদের পূর্বসূরিদের খিদমতের কথা জানুন। তাঁরা মাদরাসার চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ না থেকে ইসলাম যেখানে যে খিদমতের দাবি করেছে, সেখানেই জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন।
আপনারা জানেন, ১৮৫৭ সালে যখন ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হয়— প্রথমটি হয়েছিল ১৮৩২ সালে— যে যুদ্ধে হজরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ এবং হজরত শাহ ইসমাঈল শহীদ উভয়ই শহীদ হন। এরপর ১৮৫৭ সালে দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। এই সময় দিল্লিতে তেত্রিশ হাজার আলেমকে ফাঁসি দেয়া হয়। মীরাঠ, সাম্ভল, এবং এলাহাবাদসহ যে-সব জায়গায় স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেখানেও আলেমদের হত্যা করা হয়।
হজরত গাঙ্গুহি রহ. এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাকে বন্দি করে জেলে পাঠানো হয়। হজরত নানুতবী রহ. ব্রিটিশদের হাত থেকে কোনোক্রমে রক্ষা পান। হজরত হাজী ইমদাদুল্লাহ সাহেবকে গোপনে মক্কা মুকাররমায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়, কারণ তিনি ছিলেন সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ।
এই পরিস্থিতিতে, যখন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলো, তখন আলেমরা বুঝতে পারলেন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে গেছে। তেত্রিশ হাজার আলেমকে হত্যা করা হয়েছে। শহিদদের স্ত্রীরা ঘরে বিধবা হয়ে বসে আছেন, ছোট ছোট সন্তানরা এতিম হয়ে গেছে। বাবার অনুপস্থিতিতে মায়েরা সন্তানদের ভিক্ষা করতে পাঠাচ্ছেন, যাতে তারা ভিক্ষার খাবার নিয়ে এলে পরিবারের মুখে অন্ন জোটে।
এই সুযোগে ব্রিটিশ চার্চের লোকেরা এগিয়ে এসে মায়েদের বলত, ‘আপনার সন্তানকে আমাদের হাতে দিন। আমরা তাকে বিনামূল্যে পড়াশোনা করাবো, কাপড় দেবো, থাকার জায়গা দেবো। সে পড়াশোনা শেষ করার পর আমরা তাকে সরকারি চাকরি দেবো। এতে সে নিজেও ভালো থাকবে এবং আপনারাও ভালো থাকবেন।’ এই প্রলোভনে পড়ে অনেক মা সন্তানদের ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিতেন।
আলেমরা লক্ষ্য করলেন, যাদের বাবারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শহীদ হয়েছেন, ব্রিটিশরা এখন সেই সন্তানদের নিজেদের অনুগত বানাতে চাচ্ছে। তখন আলেমরা বসে চিন্তা করলেন এবং ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের নয় বছর পর, ১৮৬৬ সালে, দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করলেন। তারা বললেন,
আপনাদের সন্তানদের আমাদের কাছে দিন। আমরাও বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করব। আমরা তাদের পড়াবো, খাওয়াবো, পরিধানের বস্ত্র দিব এবং সেই শহীদদের সন্তানদের পুনরায় মুজাহিদ বানাবো।
ব্রিটিশদের কাছে ছিল ক্ষমতা। তারা বলত, ‘আমাদের সাম্রাজ্যের কোথাও সূর্য অস্ত যায় না।’ তারা অর্থ-সম্পদ দিয়ে শিক্ষা দিলে দিতে পারত। কিন্তু দেওবন্দের আলেমরা ছিলেন আর্থিকভাবে অসচ্ছল। তাদের কাছে এই কাজের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ ছিল না। তারা শুধু জাতিকে একটি বার্তা দিলেন— ‘আমরা একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছি। এটি যদি টিকে থাকে, তবে তোমরা টিকে থাকবে। তোমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম টিকে থাকবে। এটি যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তবে তোমরাও ধ্বংস হবে, তোমাদের প্রজন্মও ধ্বংস হবে, এবং ঈমানও অবশিষ্ট থাকবে না।’ ফলে দেখা গেল, যার যা ছিল, তা মাদরাসায় দান করে দিল।
এই একটি মাদ্রাসা থেকে আজ লক্ষাধিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে যাওয়া হয়, সেখানেই মাদ্রাসা দেখা যায়। এই মাদরাসাগুলো হয় দারুল উলুম দেওবন্দের সন্তান, নয়তো তার সন্তানের সন্তান। বাংলাদেশেও অসংখ্য মাদ্রাসা রয়েছে, যার প্রকৃত সংখ্যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। এই সব মাদ্রাসা দারুল উলুম দেওবন্দের ঐতিহ্যের ধারক।
দেওবন্দের আলেমরা একটি নীতি স্থির করেছিলেন— কোনো সরকার বা ক্ষমতাশালী ব্যক্তির অর্থে মাদ্রাসা পরিচালিত হবে না। এটি হজরত গাঙ্গুহি রহ., হজরত নানুতবী রহ., এবং হজরত শায়খুল হিন্দ রহ.-এর অনুপম নীতি-আদর্শ। এই নীতির কারণেই দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষাপদ্ধতি আজও অক্ষত। তাদের শিক্ষাব্যবস্থা আজও সংরক্ষিত।
দারুল উলুম দেওবন্দের দীর্ঘ গৌরবময় এই ইতিহাস এই বইয়ে লিপিবদ্ধ রয়েছে। যারা এই বই রচনায় ও অনুবাদে অবদান রেখেছেন, আল্লাহ তাদের কাজ কবুল করুন।
]]>