তিনি গত ২৬ সেপ্টেম্বর ভোরে স্পর্শ করেছেন পৃথিবীর অষ্টম সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট মানাসলু (২৬,৭৮১ ফুট) চূড়া। এটি বাবরের ৪র্থ ৮ হাজারি শৃঙ্গের সফলতা। বাবর ছাড়াও একইদিনে মানাসলু পর্বতের শিখরে আরোহণ করেছেন বাংলাদেশের আরেক পর্বতারোহী তানভীর আহমেদ। এটি তানভীরের প্রথম আট হাজারি শিখর অভিযান ও প্রথম অভিযানেই এসেছে এই সাফল্য।
৮ হাজার মিটার উচ্চতার আরেক শৃঙ্গ পাকিস্তানের নাঙ্গা পর্বতে আগামী বছর আরোহণ করতে চান বাবর আলী। মানাসলু জয়ের পর দেশে ফিরে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে এসব কথা বলেন এ এভারেস্টজয়ী। তার সঙ্গে ছিলেন মানাসলু অভিযানের সঙ্গী তানভীর আহমেদ।
এক প্রশ্নের জবাবে বাবর আলী বলেন, ‘এ বছরে দুইটা আট হাজারি পর্বত হয়ে গেছে। সামনে পরিকল্পনা হচ্ছে— ধীরে ধীরে বাকি যে ১০টা আট হাজার মিটার বাকি রয়ে গেছে। আই লাইক টু মুভ টু পাকিস্তান। পাকিস্তানে ৫টা আট হাজার মিটার পর্বত আছে। এর মধ্যে আমার স্বপ্নের একটা হলো নাঙ্গা পর্বত। সামনে আমি নাঙ্গা পর্বতের দিকে যেতে চাই।’
মানাসলু অভিযানে কোনো বড় প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছিলেন কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে বাবর বলেন, ‘এবার মানাসলু, কঠিন প্রস্তুতি— সহজ অভিযান হয়ে গেছে আমার জন্য। আমরা পুরো যাত্রাটা উপভোগ করেছি। এটা আমি সবাইকে বলি, পর্বতে অনেকে যেতে চায়। সঠিক প্রস্তুতি নিয়ে গেলে আপনি উপভোগ করবেন। আর না হলে আপনি লোকজনকে কষ্টের গল্প বলবেন। কষ্টটা যদি আনন্দটাকে ছাপিয়ে যায়, তাহলে আমার মনে হয় না কারো পাহাড়ে যাবার দরকার আছে। কারণ আমি উপভোগ করতে যাচ্ছি।’
আরও পড়ুন: প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়াই আট হাজার মিটার পর্বতশৃঙ্গে বাবর আলী
তিনি বলেন, ‘সামনে আরও কয়েকটা কঠিন পর্বত আছে। এভারেস্ট সবচেয়ে উঁচু। কিন্তু এটা সব থেকে কঠিন নয়। যেমন আদা দাবলাম এভারেস্টের চেয়ে অনেক কঠিন। এরকম একটি পর্বত আরোহণ করা মানে পরেরগুলোর জন্যও প্রস্তুতি।’
‘মানাসলুতে একটা সুবিধা হয়েছে, আমাকে অক্সিজেন সিলিন্ডার বহন করতে হয়নি। ৪-৫ লিটারের অক্সিজেন সিলিন্ডারটা অতিরিক্ত বহন করতে হচ্ছে না, এটা একটা সুবিধা; কিন্তু প্রত্যেকটা স্টেপ মেকস ইউ ব্রেথলেস। বাতাসের জন্য হাহাকার। সেটা ফিল করেছি।’
কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়া মানাসলু আরোহণের কারণ জানতে চাইলে বাবর আলী বলেন, ‘সব সময় দেখে এসেছি পশ্চিমারা সচরাচর এসব পাগলামিগুলো করে থাকে। বাঙালি ঘরকুনো ছিল বলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটা ট্যাগ লাগানো থাকে। যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং ওই মানসিক শক্তি থাকলে এটা সম্ভব। পরের জেনারেশন বা পরের পর্বতারোহীরা আশা করি এই ব্যাপারটা এগিয়ে নিবে। ইতিবাচক মানসিকতার সঙ্গে আমাকে সহযোগিতা করেছে নিয়মানুবর্তিতা।’
বাবর আলী বলেন, ‘সাধারণত আট হাজার মিটার পর্বতে সামিট পুশের জন্য রাতে বের হতে হয়। কারণ রাতে আবহাওয়া স্থিতিশীল থাকে। পর্বতে দুপুর ১২টার পর আবহাওয়া খারাপ হতে থাকে। আমরা ১১টা ৪০ এ রওনা দিয়ে এবং তানভীর ভাই সাড়ে ৩টায় পৌঁছায়। আর আমি একটু স্লো ছিলাম, অক্সিজেন ব্যবহার করছিলাম না। আমি পৌঁছাই সাড়ে ৪টার দিকে। তারপরও প্রত্যাশার অনেক আগেই আরোহণ করতে পেরেছি।’
তিনি বলেন, ‘এর আগেও বাংলাদেশ থেকে এভারেস্ট এবং আট হাজার মিটারের পর্বত আরোহণ হয়েছে। কিন্তু আট হাজার মিটার পর্বতে অক্সিজেন ছাড়া যাওয়ার সাহস ওভাবে আমরা আগে করে উঠতে পারিনি। আশা করি, আরও নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে পর্বতারোহীরা যাবে। ৮ হাজার মিটার কোনো পর্বতই আসলে সহজ না। অনেক কিছুর সঙ্গে লড়াই করতে হয় ওই উচ্চতায় আসলে।’
মানাসলু আরোহণকারী তানভীর আহমেদ বলেন, ‘সবচেয়ে কঠিন হলো উচ্চতা। একটা নির্দিষ্ট উচ্চতার ওপরে বিষয়টা ভিন্ন। সেখানকার তাপমাত্রা ও আবহাওয়ার সঙ্গে শরীরকে অ্যাডজাস্ট করানো এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা। ক্যাম্প ১ থেকে ক্যাম্প ২ এবং ক্যাম্প ৩ থেকে ক্যাম্প ৪ এর রাস্তা কঠিন। অনেক বড় উচ্চতা একদিনে আরোহণ করতে হচ্ছে। এটা বেশ কঠিন। নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ নিতে অভ্যস্ত বাবরের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল অতিরিক্ত অক্সিজেন ছাড়া আট হাজারি শিখর আরোহণের। বাবর এরআগে পৃথিবীর উচ্চতম পর্বত এভারেস্ট, চতুর্থ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ লোৎসে এবং দশম সর্বোচ্চ পর্বত অন্নপূর্ণা-১ নামে তিনটি আট হাজার মিটারের অধিক উচ্চতার পর্বত আরোহণ করেন। তবে অক্সিজেনবিহীন এবারের আরোহণ দেশের পর্বতারোহণকে দিয়েছে অনন্য মাত্রা।’
বাবর বলেন, ‘ভেতো আর ঘরকুনো হিসেবে বাঙালির দুর্নাম বহুদিনের। এই তথাকথিত ট্যাগ গায়ে লাগিয়ে চলছিলাম আমরা বহুদিন ধরে। পশ্চিমারা কত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে হিমালয় থেকে দারুণ সব আরোহণের কৃতিত্ব ঝুলিতে নিয়ে বাড়ি ফেরে। অথচ আমাদের বাড়ির পাশের হিমালয় হওয়া সত্ত্বেও সেখানে আমাদের কৃতিত্বের ছাপ খুব একটা বেশি নয়। নানান দেশের অসীম শক্তিধর পর্বতারোহীদের দেখে আগে ভাবতাম, আমি বা আমরাও যদি আট হাজার মিটার বা তার অধিক উচ্চতার শিখরে কৃত্রিম অক্সিজেনবিহীন আরোহণ করতে পারতাম। অবশেষে সেই স্বপ্ন সত্যি হয়ে ধরা দিলো। এই অনুভূতি বলে বোঝানোর মতো নয়। আমি আশা করব, আমার পরের পর্বতারোহীরা আরও নতুন সব
আইডিয়া নিয়ে পর্বতে যাবে। প্রতিটা পর্বত চূড়ায় লাল-সবুজ পতাকা হাতে এই মাটির কেউ দাঁড়ালে, দেশটাও তার সঙ্গে কিছুটা হলেও উপরে ওঠে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
আরও পড়ুন: বিশ্বের অষ্টম সর্বোচ্চ পর্বত অভিযানে যাচ্ছেন বাবর আলী ও তানভীর
তিনি আরও বলেন, ‘আশা করি, পরের পর্বতারোহীরাও সেই ধারা অব্যাহত রাখবে। তবে পর্বতে যাওয়াটা তো কোনো খেয়ালি ব্যাপার কিংবা দিবাস্বপ্ন নয়। এর পেছনে দীর্ঘ সাধনা আর প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। প্রস্তুতির ব্যাপারটাতে সবাই যাতে আরও বেশি মনোযোগ দেয়, সেই প্রত্যাশা থাকবে আমার।’
বাবর বলেন, ‘আমি চাই ১৪টি আট হাজারি শৃঙ্গের সবকটিতেই চড়তে। সবেমাত্র ৪টি হলো, বাকি আছে আরও ১০টি। আশা করি পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে লাল-সবুজ পতাকা হাতে বাকি ১০টি পর্বতের চূড়ায়ও আমি দাঁড়াতে পারব।’
তানভীর ও বাবর বাংলাদেশ থেকে নেপালে গিয়েছেন ৫ সেপ্টেম্বর। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে ৭ সেপ্টেম্বর তারা কাঠমান্ডু থেকে গাড়িতে যান তিলচে গ্রামে। এরপর পাঁচ দিন হেঁটে তারা পৌঁছে যান বেসক্যাম্পে। সেখানে দুদিন বিশ্রাম তারা শুরু করেন উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া। প্রথম দফা ক্যাম্প-১ (৫৭০০ মিটার) এ এক রাত কাটিয়ে তারা নেমে আসেন। একদিন বিশ্রামের পর দ্বিতীয় দফা আরোহণে তানভীর ক্যাম্প-২ (৬৩০০ মিটার) এবং বাবর ক্যাম্প-৩ এ (৬৭০০ মিটার) রাত কাটিয়ে শেষ করেন অতি উচ্চতা ও নিম্ন তাপমাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার পর্ব। একদিন বেসক্যাম্পে বিশ্রামের পর আসে চূড়ান্ত চেষ্টার ক্ষণ। তানভীর ২২ সেপ্টেম্বর বেসক্যাম্প যেকে যাত্রারম্ভ করে উঠে আসেন ক্যাম্প-১ এবং পরদিন উঠে আসেন ক্যাম্প-২। এদিকে বাবর একদিন পর রওনা দিয়ে সরাসরি উঠে আসেন ক্যাম্প-২ এ।
২৪ সেপ্টেম্বর দুজনেই ক্যাম্প-৩ তে রাত কাটিয়ে পরদিন দুপুর নাগাদ পৌঁছে যান ক্যাম্প-৪ এ ৭৪০০ মিটার। বাকিবেলা বিশ্রাম করে রাত নামতেই শুরু হয় তাদের পরম আরাধ্য চূড়ার দিকে যাত্রা। আর ২৬ সেপ্টেম্বর ভোরেই তারা পৌঁছে যান পর্বত শীর্ষে।