উম্মতের জন্য রাতভর কান্না করতেন, দোয়া করতেন নবীজি

৪ সপ্তাহ আগে
আমাদের প্রিয় নবি হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমাদের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা লিখে বুঝানো সম্ভব নয়। তিনি যে আমাদেরকে কি পরিমাণ ভালবাসতেন মহাব্বত করতেন তার সামান্য কিছু আলোকপাত করতে চাই। হতে পারে আমাদের অন্তরে তার কিছু ভালোবাসার জন্মাবে। মনের গভীরে এ কথা ফুটে উঠবে যে, তিনি আমাকে এত ভালবেসেছেন আমারও তো তাঁকে ভালোবাসা উচিত! তাই আসুন শুরু করি উম্মতের প্রতি তাঁর ভালোবাসার দুটি ঘটনা।

উম্মতের প্রতি অগাধ ভালোবাসার কারণে তিনি প্রতিদিন উম্মতের এক এক জনের কাছে গিয়ে হেদায়েতের পথে আহ্বান করতেন আর প্রতি রাতে উম্মতের জন্য আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাতেন। হজরত আবু জর রা. বলেন, এক রাতে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজ পড়লেন। সকাল পর্যন্ত নামাজে তিনি এই একটি আয়াতই পড়তে থাকলেন,

 

إِن تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ ۖ وَإِن تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তারা তো আপনারই বান্দা। আর যদি তাদেরকে ক্ষমা করেন, তবে নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী এবং প্রজ্ঞাবান। (সুরা মায়েদা, আয়াত- ১১৮)


হজরত আবু জর রা. বলেন, আমি সকালে বললাম, হে আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি সারা রাত নামাজে এই একটি আয়াতই পাঠ করলেন। এর দ্বারাই রুকু সিজদা করলেন। এর কারণ কী? নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-


إِنِّي سَأَلْتُ رَبِّي عَزَّ وَجَلَّ الشَّفَاعَةَ لِأُمّتِي، فَأَعْطَانِيهَا، وَهِيَ نَائِلَةٌ -إِنْ شَاءَ اللَّهُ- لِمَنْ لَا يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا
আমি আমার রবের নিকট উম্মতের জন্য (হাশরের ময়দানে) সুপারিশ করার আবেদন করেছি। তিনি আমার আবেদন গ্রহণ করেছেন। যারা আল্লাহর সাথে শিরক করবে না তারা আমার সুপারিশ পাবে, ইনশাআল্লাহ। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস- ২১৩২৮)


আরেক রাতের ঘটনা

 

সাহাবায়ে কেরামকে সঙ্গে নিয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সফরে বের হলেন। নামাজের সময়টুকু ছাড়া বিরতিহীন সফর করলেন। দিন পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো, এক সময় রাতের আঁধারে সন্ধ্যাও হারিয়ে গেলো, তবুও অবিরাম সফর চলতে থাকল।


অবশেষে মধ্যরাতে যাত্রা বিরতি করলেন। সাহাবি হজরত আউফ বিন মালেক রাজি: এই সফরে ছিলেন। তিনি বলেন, যখন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উটে বসার আসন (হাওদা) নিচে নামিয়ে রাখা হল, তখন এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাহারা দিচ্ছিল। একটু পর তার কাছে গিয়ে দেখি সে ঘুমে আচ্ছন্ন। উটগুলোও মাটিতে গলা নামিয়ে আরামে ঘুমাচ্ছে।

 

আরও পড়ুন: নবীজির চোখে সেরা ১২ মানুষ


রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাওদা যেখানে রাখা হয়েছিল, ভালো করে তাকিয়ে দেখি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে নেই। দ্রুত পায়ে হাওদাগুলো অতিক্রম করে আমাদের বিশ্রামের জায়গায় এসেও রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাকে পেলাম না। এরপর রাতের অন্ধকারে সামনের দিকে হাঁটতে থাকি। হঠাৎ ঘন্টির মতো আওয়াজ শুনতে পেয়ে দাঁড়িয়ে যাই। সামনেই ছিলেন মুআজ ইবনে জাবাল রাজি. এবং আবু মুসা আশআরী রাজি.। তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর রসুল কোথায়? এরপর যাতা (বা চাক্কি) ঘুরানোর শব্দ ভেসে এলো। (রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ওহি অবতীর্ণ হওয়ার সময় যেহেতু এ ধরণের শব্দ শোনা যেতো)


তাই বললাম, আল্লাহর রাসুল হয়তো এই আওয়াজের কাছেই আছেন। তারা দুজন আমাকে বললেন, চুপ করে বসে থাকো! কিছুক্ষণ পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট এলেন। আমারা দাঁড়িয়ে গেলাম এবং বললম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনাকে না পেয়ে আমরা ভীষণ ভয় পেয়েছি। ফলে আমরা এতক্ষণ যাবৎ আপনাকে খুঁজছিলাম। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,


إِنَّهُ أَتَانِي آتٍ مِنْ رَبِّي فَخَيَّرَنِي بَيْنَ أَنْ يَدْخُلَ نِصْفُ أُمَّتِي الْجَنَّةَ وَبَيْنَ الشَّفَاعَةِ، فَاخْتَرْتُ الشَّفَاعَةَ আমার কাছে আমার প্রভুর পক্ষ থেকে একজন ফেরেশতা আগমন করেছে আর বলেছে যে, আল্লাহ তাআলা আমাকে দুইটি বিষয়ের মধ্য থেকে যে কোনো একটি গ্রহণ করতে বলেছেন।


এক. আমার অর্ধেক উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে। দুই. অথবা আমি উম্মতের জন্য সুপারিশ করবো। তখন আমি সুপারিশকেই গ্রহণ করলাম। সাহাবায়ে কেরামের আগ্রহ আর উদ্দীপনা দেখুন, এই ঘটনার বর্ণনাকারী সাহাবি মালেক বিন আউফ রাজি: বলেন- আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে রাসুলের সঙ্গে আমাদের সোহবতের দোহাই দিয়ে আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, যদি আপনি আমাদেরকে আপনার সুপারিশপ্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত করে নিতেন! তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (ঠিক আছে) তোমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত। এরপর আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। ইতিমধ্যে দুই একজন করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসলো। আল্লাহর রাসূল তাদেরকেও সেই সংবাদ শুনালেন। তারাও আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে রাসুলের সঙ্গে তাদের সোহবতের দোহাই দিয়ে সুপারিশের অনুরোধ করল। তিনি তাদের অনুরোধও গ্রহণ করে নিলেন।

 

এরপর কাফেলার সকলে এসে সুপারিশের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘিরে ধরলো। তখন তিনি বললেন,

 

فَإِنِّي أُشْهِدُكُمْ أَنَّهَا لِمَنْ مَاتَ مِنْ أُمَّتِي لَا يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا তোমাদেরকে সাক্ষ্য রেখে বলছি, নিশ্চয় আমার সুপারিশ আমার উম্মতের প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি লাভ করবে, যে শিরকমুক্ত অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস- ২৩৯৭৭)


প্রিয় ঈমানী ভাই ও বোনেরা! নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুপারিশ করাকে এ জন্যই কবুল করেছেন, যেন তিনি সুপারিশ দ্বারা উম্মতের যে সকল মুসলমান জাহান্নামে চলে যাবে, তাদেরকে তিনি জাহান্নাম থেকে মুক্ত করতে পারেন। তবে নামের মুসলমান যারা শিরকের মাঝে লিপ্ত, তারা কিছুতেই তাঁর সুপারিশ পাবে না এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তিও পাবে না।
(তুহফাতুল আলমায়ি, খন্ড- ৬, পৃ. ২১৩)

 

হাশরের ময়দানে পাঁচ ধরনের মানুষের জন্য সুপারিশ হবে।এক. সকল হাশরবাসীর কষ্ট দূর করে তাড়াতাড়ি হিসাব শুরু করার জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ। যা শুধুমাত্র আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করবেন, ইনশাআল্লাহ। যাকে শাফায়াতে কোবরা বা বড় সুপারিশ বলা হয়।দুই. বিনা হিসাবে (কিছু মানুষকে) জান্নাতে প্রবেশ করানোর জন্য সুপারিশ। এটাও আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করবেন।


তিন. যাদের জন্য জাহান্নামে যাওয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। সুপারিশের মাধ্যমে তারা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবেন। এ ধরনের সুপারিশে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং যাদেরকে আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করবেন তাদেরকে সুপারিশ করার অনুমতি দিবেন। চার. যারা নিজেদের অন্যায়ের কারণে জাহান্নামে চলে গেছে, তারা আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ফেরেশতা এবং তাদের অন্যান্য মুমিন ভাইদের সুপারিশে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবেন।
পাঁচ. সর্বশেষ জান্নাতিদের জন্য জান্নাতে তাদের মাকাম ও মর্যাদা বৃদ্ধির সুপারিশ করবেন। (মিরকাতুল মাফাতিহ, খন্ড- ১০, পৃ. ২৭০-২৭১) তথ্যসূত্র: উম্মতের প্রতি নবিজির ভালোবাসা পৃ: ১৪,১৫,১৬,১৭,১৮


লেখক: সিনিয়র শিক্ষক, লালবাগ মাদ্রাসা ঢাকা, খতিব, আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ, পরিচালক, দাওয়াতুস সুন্নাহ বাংলাদেশ

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন