আবার অনেকেই হয়তো আজ সকালে ফ্রিজ খুলে দেখেছেন, আহা! এত মাংস জমে আছে, এবার একটু দান করা যাক।
অথচ ঠিক তখনই শহরের এক কোনায় কিংবা গ্রামের এক মাটির ঘরে একজন মা তার বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে বলছেন, বাবা, আজ আর একটু ধৈর্য করো।
ঈদ তো শেষ হচ্ছে, হয়তো কেউ আজ একটা টুকরো দেবে। হ্যাঁ, আজ ঈদের তৃতীয় দিনেও এমন হাজারো পরিবার আছে, যাদের ঘরে ঈদ আসেই না। ঈদের নামটা শোনে ঠিকই, কিন্তু তার কোনো গন্ধ, কোনো স্বাদ, কোনো আনন্দ তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছায় না।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআনে বলেন;
فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ তোমরা তা খাও এবং খাওয়াও সেই অভাবগ্রস্তকে, যে কিছু চায় না (লজ্জায়), এবং তাকেও যে প্রকাশ্যে চায়। (সুরা হজ্জ: ৩৬)
এ আয়াতে আল্লাহ মানুষকে দুটি শ্রেণির দরিদ্রদের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, একজন লজ্জাবশত মুখ ফুটে কিছু বলে না, আরেকজন নিরুপায় হয়ে হাত পাতে। ঈদের দিনে এই দুই শ্রেণিকেই খাওয়ানো কোরবানির মূল উদ্দেশ্যের একটি।
রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, প্রতিবেশীর ক্ষুধা মানে আমার ঈদে ঘাটতি
ليس المؤمن الذي يشبع وجاره جائع إلى جنبه সে প্রকৃত মুমিন নয়, যে নিজে তৃপ্ত হয় আর তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে। (আদাবুল মুফরাদ:)
আজ আমাদের গেটের বাইরে, বাড়ির পাশে কিংবা পেছনের গলিতে যারা থাকেন,তাদের অনেকেই হয়তো ঈদের তিন দিনই শুধু খালি ভাত খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন। কই, আমরা কি তাদের খোঁজ নিয়েছি?
ঈদের নামে বৈষম্যের এক নির্মম চিত্র
একদিকে শহরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে কোরবানির ৫০ কেজি মাংস বণ্টনের পরিকল্পনা চলছে,কে কাকে দেবে, কে কতটা দেবে, কাকে বাদ দেওয়া যায়। অন্যদিকে পিচঢালা রাস্তায় ছেঁড়া কাপড়ে ঘুমানো পাঁচ বছরের শিশুটি বলে, “আম্মু, ঈদ কি শুধু টিভির ভিতরেই হয়?
তিনদিনেও একটুকরো গোশত সে মুখে দেয়নি। কারণ তার বাড়ির সামনে কোনো বিত্তবান থেমে দাঁড়ায়নি।
ঈদে কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য কী?
لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَىٰ مِنْكُمْ আল্লাহর কাছে কোরবানির গোশত বা রক্ত কিছুই পৌঁছায় না; বরং তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছে। ( সুরা হজ্জ: ৩৭)
তাহলে যদি গরুর দাম, গোশতের পরিমাণ আর মাংস সংরক্ষণই আমাদের ঈদের সুখ হয়, তবে আল্লাহর কাছে কি আদৌ আমাদের কোরবানি গৃহীত হচ্ছে?
বাস্তব ঘটনা: যে কিশোরীর চোখে পানি এসেছিল
চট্টগ্রামের এক বস্তিতে ঈদের দিন দুপুরে এক কিশোরী ছাদে উঠে দাঁড়িয়ে ছিল। পাশের বিল্ডিং থেকে ভেসে আসছিল গরুর গোশত ভাজার গন্ধ। সে চোখ মুছতে মুছতে বললো, আম্মু, আমরা গরীব, ঠিক আছে। কিন্তু আল্লাহ কি গরীবদের জন্য কোনো ঈদ রাখেননি?
আল্লাহর কসম! এই প্রশ্নটা যদি আমাদের হৃদয় কাঁপিয়ে না তোলে, তবে আমরা কীভাবে এই উম্মতের অংশ হতে পারি?
এখনো সময় আছে ঈদের তৃতীয় দিনেই হোক, চারপাশে দেখে নিই,কে খেয়েছে, কে খায়নি।
কোরবানির মাংস গুছিয়ে ফ্রিজে রাখার আগে একবার ভাবুন,আরেকটা পরিবার আজও চুলা জ্বালাতে পারেনি।
কোরবানিকে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করি,মনের তাকওয়ার প্রতিফলন হিসেবে।
দানের হাতকে এমনভাবে বাড়িয়ে দিই, যেন ঈদ হয় সবার, শুধু আমাদের ঘরের চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ না থাকে।
ঈদ যেন শব্দ না হয়ে অনুভূতির নাম হয়
ঈদ এমন একটি আনন্দ, যা একা উদযাপন করলে তার কোনো অর্থ নেই। ঈদের মানে হলো, হাসি ভাগ করে নেওয়া, অন্তত একটা পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো।
আমাদের বাড়ির ছাদে ধোঁয়া উঠে না-উঠুক, পাশে সেই বিধবা মা’র চুলায় আগুন জ্বলুক,এই চিন্তাটা থাকলেই ঈদ পরিপূর্ণ হয়। আসুন, ঈদের তৃতীয় দিনে আমরা এমন এক কাজ করি,যা আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
]]>