ইসলামের দৃষ্টিতে বাজেট ভাবনা

১ সপ্তাহে আগে
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করছেন। এটি দেশের ৫৪তম, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও অর্থ উপদেষ্টার প্রথম বাজেট।

ইসলামে বাজেটের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। ইসলাম একটি স্বভাবজাত ধর্ম। কোরআন-হাদিসে বর্ণিত প্রতিটি নির্দেশনা মানুষের স্বভাবসম্মত, সুবিন্যস্ত এবং পরিপাটি। ইসলামে বাজেটকে একটি জাতীয় আমানত হিসেবে দেখা হয়। বাজেটের সঙ্গে দেশের উন্নতি-অগ্রগতি ও এর ওপর ভিত্তি করে একটি দেশ যেমন এগিয়ে যায়, তেমনি অপরিকল্পিত বাজেটের কারণে একটি দেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণ ধ্বংসও হয়ে যেতে পারে।

 

ইসলামি অর্থব্যবস্থায় বাজেট প্রণয়নের মৌলিক নীতিমালা হলো, সবার আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া। তারপর তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া এবং এভাবে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে আসা। ইসলাম অপ্রতুল বিলাসী বাজেট সমর্থন করে না। 

 

আরও পড়ুন: ধর্ম মন্ত্রণালয়ের জন্য ২ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব

 

পবিত্র কোরআনে বাজেটের ধারণা

 

পবিত্র কোরআন থেকে জাতীয় বাজেটের ধারণা পাই। প্রাচীন মিসরে হযরত ইউসুফ (আ.) কে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে এবং নির্দিষ্ট মেয়াদি অর্থব্যবস্থা সংরক্ষণের ঘটনা বর্ণনা করে মহান আল্লাহ আমাদের সে শিক্ষাই দিয়েছেন। তৎকালীন মিসরের বাদশাহ এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন। পবিত্র কোরআনের ভাষায়,

 

وَ قَالَ الۡمَلِكُ اِنِّیۡۤ اَرٰی سَبۡعَ بَقَرٰتٍ سِمَانٍ یَّاۡكُلُهُنَّ سَبۡعٌ عِجَافٌ وَّ سَبۡعَ سُنۡۢبُلٰتٍ خُضۡرٍ وَّ اُخَرَ یٰبِسٰتٍ অর্থ: বাদশাহ বলল, আমি স্বপ্নে দেখলাম, সাতটি মোটাতাজা গাভি এদেরকে সাতটি শীর্ণ গাভি খেয়ে যাচ্ছে এবং সাতটি সবুজ শীষ ও অন্যগুলো শুষ্ক। (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৪৩)

 

মহান আল্লাহ ইউসুফ (আ.)-কে স্বপ্নের ব্যাখ্যার জ্ঞান দান করেছিলেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যার জন্য ইউসুফ (আ.)-কে রাজদরবারে ডাকা হলো। তিনি বাদশাহর স্বপ্নের বিবরণ শুনে বুঝে ফেললেন এবং আসন্ন দুর্ভিক্ষের কথা জানালেন। তিনি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সচল রাখতে ভবিষ্যৎ বাজেট পরিকল্পনার একটি খসরা করে দিলেন। মহান আল্লাহ বলেন,

 

قَالَ تَزۡرَعُوۡنَ سَبۡعَ سِنِیۡنَ دَاَبًا ۚ فَمَا حَصَدۡتُّمۡ فَذَرُوۡهُ فِیۡ سُنۡۢبُلِهٖۤ اِلَّا قَلِیۡلًا مِّمَّا تَاۡكُلُوۡنَ - ثُمَّ یَاۡتِیۡ مِنۡۢ بَعۡدِ ذٰلِكَ سَبۡعٌ شِدَادٌ یَّاۡكُلۡنَ مَا قَدَّمۡتُمۡ لَهُنَّ اِلَّا قَلِیۡلًا مِّمَّا تُحۡصِنُوۡنَ - ثُمَّ یَاۡتِیۡ مِنۡۢ بَعۡدِ ذٰلِكَ عَامٌ فِیۡهِ یُغَاثُ النَّاسُ وَ فِیۡهِ یَعۡصِرُوۡنَ অর্থ: ইউসুফ স্বপ্নের ব্যাখ্যায় বললেন, তোমরা সাত বছর উত্তম রূপে চাষাবাদ করবে। অতঃপর যা কাটবে, তার মধ্যে যে সামান্য পরিমাণ তোমরা খাবে তা ছাড়া অবশিষ্ট শস্য শীষসহ রেখে দেবে এবং এরপরে আসবে দুর্ভিক্ষের সাত বছর; তোমরা এ দিনের জন্য যা রেখেছিলে, তা খেয়ে যাবে। কিন্তু অল্প পরিমাণ ছাড়া, যা তোমরা তুলে রাখবে। এর পরেই আসবে এক বছর-তখন মানুষের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হবে এবং তখন তারা রস নিংড়াবে। (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৪৭-৪৯)

 


আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, নবী ইউসুফ (আ.) এখানে ১৪ বছরের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন এবং আসন্ন দুর্যোগ ও সংকট মোকাবিলায় দেশের উৎপাদন ও আয়-ব্যয়ের হিসাব করে দিয়েছেন। ইউসুফ (আ.)-এর আল্লাহ প্রদত্ত এই অভূতপূর্ব পরামর্শে বিমোহিত হয়ে বাদশাহ তাকে নিজের একান্ত সহযোগী হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব করলেন। মহান আল্লাহ বলেন, 

 

وَ قَالَ الۡمَلِكُ ائۡتُوۡنِیۡ بِهٖۤ اَسۡتَخۡلِصۡهُ لِنَفۡسِیۡ অর্থ: বাদশাহ বলল, তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তাকে নিজের বিশ্বস্ত সহচর করে রাখব। (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৫৪)

 

কিন্তু ইউসুফ (আ.) এ প্রস্তাব শুনে নিজের পক্ষ থেকে আরও একটি আবেদন করলেন। মহান আল্লাহ বলেন,

 

قَالَ اجۡعَلۡنِیۡ عَلٰی خَزَآئِنِ الۡاَرۡضِ অর্থ: ইউসুফ বলল, আমাকে দেশের ধন-ভান্ডারে নিযুক্ত করুন। (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৫৫)

 

নবী ইউসুফ (আ.) কেন অর্থমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পেশ করেছিলেন? এর কারণও তিনি নিজেই বর্ণনা করেছিলেন,

 

اِنِّیۡ حَفِیۡظٌ عَلِیۡمٌ অর্থ: আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও অধিক জ্ঞানবান। (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৫৫)। 

 

অপচয় ও অপব্যয় বন্ধ করা  

 

সুষ্ঠু বাজেটের জন্য অপচয় ও অপব্যয় থেকে বেঁচে থাকতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় করা অপচয়। আর অবৈধ কাজে ব্যয় করা হলো অপব্যয়। দুটোই ইসলামে দোষণীয় ও নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ বলেন,

 

وَّ كُلُوۡا وَ اشۡرَبُوۡا وَ لَا تُسۡرِفُوۡا ۚ اِنَّهٗ لَا یُحِبُّ الۡمُسۡرِفِیۡنَ  অর্থ: তোমরা আহার করবে ও পান করবে। কিন্তু অপচয় করবে না। তিনি অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না। (সুরা আরাফ, আয়াত: ৩১)

 

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

 

وَ اٰتِ ذَاالۡقُرۡبٰی حَقَّهٗ وَ الۡمِسۡكِیۡنَ وَ ابۡنَ السَّبِیۡلِ وَ لَا تُبَذِّرۡ تَبۡذِیۡرًا - اِنَّ الۡمُبَذِّرِیۡنَ كَانُوۡۤا اِخۡوَانَ الشَّیٰطِیۡنِ ؕ وَ كَانَ الشَّیۡطٰنُ لِرَبِّهٖ كَفُوۡرًا  অর্থ: তোমরা কিছুতেই অপব্যয় করবে না। যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই আর শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ। (সুরা ইসরা, আয়াত: ২৬-২৭)

 

অনেক মানুষ অপ্রয়োজনে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ছেড়ে রাখেন। এতে দেশের সামগ্রিক জ্বালানি ও খনিজ সম্পদে চাপ বাড়ে, যার প্রভাব পড়ে ব্যক্তিজীবনেও। বাজেটের ঘাটতি দূর করতে সব ধরনের অপচয় ও অপব্যয়মূলক ব্যয় বন্ধ করা নিশ্চিত করতে হবে। 

 

দুর্নীতি দমন করা 
 

ইসলামে লেনদেনে স্বচ্ছতা জরুরি। দুর্নীতি ও আর্থিক পাপের মাধ্যমে ইবাদত নষ্ট হয়। যেমন, অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ গ্রাস করা বা জবর দখল করা, এতিমের মাল ভক্ষণ করা, ঋণ পরিশোধ না করা, অন্যের প্রাপ্ত অধিকার প্রদান না করা, চুরি বা সন্ত্রাসী করে অন্যের মাল ভোগ করা, সরকারি সম্পদের যথার্থ ব্যবহার না করা ইত্যাদি। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

 

তোমরা কি জানো প্রকৃত দরিদ্র কে? সাহাবারা বললেন, আমাদের মধ্যে দরিদ্র ওই ব্যক্তি, যার কোনো অর্থ ও সম্পদ নেই। নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে দরিদ্র ওই ব্যক্তি, যে কেয়ামতের দিন নামাজ, রোজা, জাকাত নিয়ে আসবে। সে আরও নিয়ে আসবে অন্যকে এই পরিমাণ গালি দিয়েছে, এই পরিমাণ মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, এই পরিমাণ সম্পদ খেয়েছে, এই পরিমাণ রক্ত প্রবাহিত করেছে, অন্যকে এই পরিমাণ প্রহার করেছে। তার নেকি থেকে এই পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্তকে প্রদান করতে হবে। তার দায় শেষ হওয়ার আগেই তার নেকি শেষ হয়ে যাবে। তখন ক্ষতিগ্রস্তদের পাপ থেকে এই পরিমাণ নিয়ে তার ওপর নিক্ষেপ করা হবে। অবশেষে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। (মুসলিম: ৬৭৪৪)। 

 

জাকাত ব্যবস্থা জোরদার করা 


ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ইবাদত হলো জাকাত। সম্পদশালী মুসলিম নর-নারীর ওপর বছর শেষে তার সম্পদের ৪০ ভাগের এক ভাগ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রদান করতে হয়। পৃথিবীর সব মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য যা দরকার আল্লাহ তা সৃষ্টি করেছেন। সুষম বণ্টনের অভাবে ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। জাকাত এই বৈষম্য দূর করে সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে। মহান আল্লাহ বলেন, 

 

إِنَّ  الَّذِينَ  آمَنُوا  وَعَمِلُوا  الصَّالِحَاتِ  وَأَقَامُوا  الصَّلَاةَ  وَآتَوُا  الزَّكَاةَ  لَهُمْ  أَجْرُهُمْ  عِندَ  رَبِّهِمْ  وَلَا  خَوْفٌ  عَلَيْهِمْ  وَلَا  هُمْ  يَحْزَنُونَ অর্থ: নিশ্চয় যারা বিশ্বাস করে এবং সংশোধনমূলক সৎকর্ম করে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং জাকাত প্রদান করে তাদের জন্য তাদের প্রভুর কাছে তাদের পারিতোষিক আছে। আর তাদের কোনো ভয় থাকবে না আর তারা দু:খিতও থাকবে না। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৭৭)

 

আরও পড়ুন: দেশে আরাফার রোজা কী বার?

 

আয় বুঝে ব্যয় সামঞ্জস্যতা রাখা
 

আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্যতা না থাকলে দরিদ্রতা এগিয়ে আসে। অনেক সময় ঋণগ্রস্ত হয়ে বাস্তুভিটাও হারিয়ে যেতে পারে। আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্যতা থাকলে সাধারণত অভাব আসে না। মহান আল্লাহ বলেন, 

 

وَ لَا تَجْعَلْ یَدَكَ مَغْلُوْلَةً اِلٰی عُنُقِكَ وَ لَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُوْمًا مَّحْسُوْرًا অর্থ: তুমি একেবারে ব্যয়কুণ্ঠ হইয়ো না এবং একেবারে মুক্তহস্তও হইয়ো না। তাহলে তুমি তিরস্কৃত, নিঃস্ব হয়ে বসে থাকবে।

 

নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 

 

যে ব্যক্তি ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে, সে কখনো অভাবগ্রস্ত হয় না। (মুসনাদে আহমাদ: ৪২৬৯)

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন