ইসলামি ১২ মাসের তাৎপর্য ও ফজিলত

২ সপ্তাহ আগে
ইসলাম ধর্ম শুধু একটি বিশ্বাস নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এই ধর্মে সময়ের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই তো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট মাসসমূহ বারোটি, আল্লাহর কিতাবে যেদিন তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। (সুরা তাওবাহ: ৩৬)

এই ১২টি মাস নিয়ে গঠিত ইসলামি বর্ষপঞ্জি, যাকে হিজরি ক্যালেন্ডার বলা হয়। প্রতিটি মাসের রয়েছে এক অনন্য ইতিহাস, শিক্ষা, ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য। কিছু মাসে নির্দিষ্ট ইবাদত বেশি ফজিলতপূর্ণ, আবার কিছু মাসে সংঘটিত হয়েছে ইতিহাসের অবিস্মরণীয় ঘটনা, মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা, আমল ও জীবনের গতিপথকে প্রভাবিত করে।

 

১. মুহাররম (ٱلْمُحَرَّم) – নিষিদ্ধ


মুহাররম ইসলাম ধর্মে অত্যন্ত পবিত্র মাস। এই মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ করা নিষিদ্ধ। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রমজানের পর সবচেয়ে উত্তম রোজা মুহাররম মাসের। এই মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। আশুরার দিন বহু ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক হলো কারবালার ঘটনা। নবীজীর দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রা.) পরিবার-পরিজনসহ শহীদ হন এই দিনে।

 

আরও পড়ুন: কোরআনে বর্ণিত যে ১০ শ্রেণির মানুষকে আল্লাহ অপছন্দ করেন

 

২. সফর (صَفَر) – শূন্যতা


সফর শব্দের অর্থ শূন্য বা ফাঁকা। পুরনো আরব সমাজে এই মাসে ঘরবাড়ি ফাঁকা করে যুদ্ধ ও লুটতরাজে বেরিয়ে পড়ত। ইসলামের ইতিহাসে এই মাসে দু’টি যুদ্ধ সংঘটিত হয় আবওয়ার যুদ্ধ (২ হিজরি) এবং খায়বার যুদ্ধ (৭ হিজরি)। যদিও ইসলামি ফিকহে এই মাসে অমঙ্গলের ধারণা ভিত্তিহীন।

 

৩. রবিউল আউয়াল (رَبِيع ٱلْأَوَّل) – প্রথম বসন্ত


রবিউল আউয়াল মাসটি নবীজীর জন্ম, হিজরত ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মৃতিবাহী। মুসলিমদের কাছে এ মাসটি অত্যন্ত সম্মানিত, কারণ এই মাসেই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন এই মাসেই, যা ইসলামী ক্যালেন্ডারের সূচনাও।

 

৪. রবিউস সানি (رَبِيع ٱلْآخِر) – দ্বিতীয় বসন্ত


এই মাসে ইসলামের কোনো নির্দিষ্ট ইবাদত নির্ধারিত না থাকলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হয়েছিল—ফুরু' মিন বুহরান। এই যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা.) অংশগ্রহণ করেননি, বরং একজন সাহাবীকে পাঠান বাহিনীর নেতৃত্ব দিতে। এ থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে, দায়িত্ব ভাগাভাগি করাও সুন্নাহর অংশ।

 

৫. জুমাদা উল আউয়াল (جُمَادَىٰ ٱلْأُولَىٰ) – শুকনো ভূমির শুরু


জুমাদা শব্দটি এসেছে শুষ্কতা থেকে। এই মাসে রাসূল (সা.) তার প্রথম স্ত্রী খাদিজা (রা.)-কে বিবাহ করেন। তার দাদা আব্দুল মুত্তালিব (রা.)-এর ইন্তেকালও এই মাসে। ইসলামের ইতিহাসে মুতার যুদ্ধের জন্যও এই মাস বিখ্যাত, যেখানে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)-কে “আল্লাহর তরবারি” উপাধি দেওয়া হয়।

 

৬. জুমাদা আল আখিরাহ (جُمَادَىٰ ٱلْآخِرَة) – শুকনো ভূমির শেষ


এই মাসে ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই মাসেই বিখ্যাত ইয়ারমুক যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যেখানে মুসলমানরা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিশাল বাহিনীর মুখোমুখি হন।

 

৭. রজব (رَجَب) – সম্মান ও মর্যাদা


রজব চারটি পবিত্র মাসের একটি। এই মাসে যুদ্ধ নিষিদ্ধ এবং ইবাদতের ফজিলত অনেক বেশি। এই মাসে ইসরা ও মিরাজের মহান ঘটনা সংঘটিত হয়, যেখানে নবীজি (সা.) আসমানে গমন করেন এবং সালাতের হুকুম আনেন। রজবে ইবাদত, দোয়া ও রোজার বিশেষ ফজিলত রয়েছে।

 

৮. শা’বান (شَعْبَان) – ছড়িয়ে পড়া


শা’বান মাসে নবীজি (সা.) অধিক রোজা রাখতেন এবং এই মাসে মধ্যরাত অর্থাৎ ১৫ শা’বানের রাতকে বলা হয় শবে বরাত বা মুক্তির রাত। এ রাতে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়, এবং বান্দাদের ক্ষমা চাওয়ার বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়। কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া, ইবাদতের মাধ্যমে এই রাতকে আলোকিত করা হয়।

 

৯. রমজান (رَمَضَان) – দহন বা জ্বলন


রমজান ইসলামি বর্ষপঞ্জির সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ মাস। এই মাসে রোজা ফরজ করা হয়, যা ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। রমজানে কুরআন নাজিল হয় এবং এতে রয়েছে লাইলাতুল কদর—এক রাত যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এই মাস ইবাদত, তাওবা, দান-সদকা এবং আত্মশুদ্ধির মাস।

 

১০. শাওয়াল (شَوَّال) – উন্নত হওয়া


রমজানের পরে আসে শাওয়াল, যেখানে মুসলমানরা ঈদুল ফিতর উদযাপন করে। এই মাসে ছয়টি অতিরিক্ত রোজা রাখলে সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব পাওয়া যায়। নবীজি (সা.) আয়েশা (রা.)-কে এই মাসেই বিবাহ করেন। ৩ হিজরিতে বিখ্যাত উহুদের যুদ্ধও এই মাসে হয়।

 

১১. যুল ক্বাদা (ذُو ٱلْقَعْدَة) – বসে থাকা / যুদ্ধ বিরতি


যুল ক্বাদা শান্তির মাস—এ মাসেও যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ। রাসূল (সা.) ৭ হিজরিতে এই মাসে মক্কায় গিয়ে উমরাহ পালন করেন। খন্দকের যুদ্ধ এই মাসেই সংঘটিত হয়। ২৫ তারিখের রাতে কাবাঘর কেন্দ্র করে বিশেষ বরকতের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যেখানে ইবাদতের মাধ্যমে অতীতের পাপ মোচনের সুযোগ রয়েছে।

 

১২. যুল হিজ্জা (ذُو ٱلْحِجَّة) – হজের মাস


এই মাস ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজের মাস। দুনিয়ার সব প্রান্ত থেকে মুসলমানরা মক্কায় এসে হজ পালন করেন। প্রথম দশ দিন অত্যন্ত বরকতময়—তন্মধ্যে ৯ তারিখে আরাফাহর দিন এবং ১০ তারিখে ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়। এ মাস আত্মত্যাগ, একতা এবং আল্লাহর আনুগত্যের চূড়ান্ত নিদর্শন বহন করে।

 

আরও পড়ুন: যেভাবে দোয়া করে বদ্ধ গুহা থেকে বেঁচে ফিরলেন তিন যুবক

 

ইসলামি বর্ষপঞ্জির ১২টি মাস শুধু সময় পরিমাপের একক নয়—বরং প্রতিটি মাসে লুকিয়ে আছে মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস, আত্মত্যাগ, শিক্ষা ও ইবাদতের অমূল্য ধনভাণ্ডার। মুহাররমের আশুরা আমাদের শহীদের আত্মোৎসর্গের কথা স্মরণ করায়, রমজান আমাদের তাকওয়ার পথে চালিত করে, আর যুল হিজ্জা আমাদের শেখায় ত্যাগ ও আনুগত্যের মহৎ আদর্শ।

 

এই ১২টি মাসের প্রতিটি মুহূর্তই মুসলমানদের জন্য একটি সুযোগ—আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, আত্মশুদ্ধি, এবং নবী করীম (সা.)-এর জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার। সময় আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, আর ইসলাম এই সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর উপদেশ দেয়।

 

আসুন, আমরা এই মাসগুলোর ফজিলত, শিক্ষা ও ইতিহাসকে হৃদয়ে ধারণ করি, এবং নিজ নিজ জীবনে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করি। তাহলেই আমরা পরকালীন সফলতার পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারব, ইনশাআল্লাহ।
 

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন