ইরানের গোপন পরমাণু স্থাপনায় যেভাবে হামলা চালায় ইসরাইল

১ দিন আগে
গত মাসে হামলা চালিয়ে ইরানের রাজধানী তেহরানের অদূরে পারচিনে অবস্থিত তালেঘান-২ নামের একটি গোপন পরমাণু স্থাপনা ইসরাইল ধ্বংস করে দিয়েছে বলে দিনতিনেক আগে এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম এক্সিওস। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে মুখ খোলেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু। তার আগ পর্যন্ত অবশ্য এই হামলায় ইরানের পরমাণু স্থাপনাকে টার্গেট করার ব্যাপারে এতদিন নিশ্চুপ ছিল ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ।

সোমবার (১৮ নভেম্বর) ইসরাইলি পার্লামেন্ট নেসেটে দেয়া বক্তৃতায় ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলার বিষয়টি স্বীকার করেন নেতানিয়াহু। তিনি বলেন, ইরানের পরমাণু স্থাপনাও ছিলো এই হামলার লক্ষ্য। এ ব্যাপারে বিবিসি তাদের প্রতিবেদনে জানায়, ‘নেতানিয়াহু ইসরাইলি পার্লামেন্টে বলেন, এটা কোনো গোপন বিষয় নয়। ইরানের পরমাণু কর্মসূচির কিছু নির্দিষ্ট অংশ লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে।’ তবে তিনি এই পরমাণু স্থাপনায় হামলার ব্যাপারে আর বিস্তারিত জানাননি বলে জানায় বিবিসি।


ইরানি হামলার প্রতিশোধ নিতেই ইসরাইলের হামলা


ইসরাইলি হামলা হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়া এবং হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরুল্লাহ হত্যার প্রতিশোধ নিতে গত ১ অক্টোবর ইসরাইলের অভ্যন্তরে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। সব মিলিয়ে ইসরাইলের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে দুই শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান। এর জবাবে অক্টোবর মাসের ২৬ তারিখে ইরানের অভ্যন্তরে পাল্টা হামলা চালায় ইসরাইল। 

 

মূলত ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ইসরাইল এসব হামলা চালানোর দাবি করলেও, সে সময় কোন জ্বালানি কিংবা পরমাণু স্থাপনাকে এসব হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে এমন দাবি করা থেকে বিরত থাকে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ। তবে এই হামলায় ইরানের তিনটি সোভিয়েত নির্মিত এস-৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয় বলে দাবি করেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। অবশ্য নেতানিয়াহুর এসব দাবির ব্যাপারে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য জানায়নি ইরান।


পরমাণু অস্ত্রের গোপন গবেষণাগার ছিলো তালেঘান-২ কমপ্লেক্স


ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পারচিন মিলিটারি কমপ্লেক্সে অবস্থিত এই তালেঘান-২ গবেষণাগার। সেখানে ইরান অত্যন্ত গোপনে পরমাণু অস্ত্রের গবেষণা চালাচ্ছিলো বলে এক্সিওস -এর কাছে দাবি করেন ইসরাইলি ও মার্কিন কর্মকর্তারা। হামলায় পরমাণু অস্ত্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি ধ্বংস করা হয় বলে দাবি করেন তারা।

 

আরও পড়ুন: পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাখ্যান করে যা বললো ইরান


পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সমঝোতার অংশ হিসেবে ২০০৩ সালে পরমাণু কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে ত্যাগ করে ইরান। তার আগে দেশটির পরমাণু কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো পারচিন মিলিটারি কমপ্লেক্সে অবস্থিত এই তালেঘান-২ গবেষণাগারটি।


যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাংক ইন্সটিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি’র উদ্ধৃতি দিয়ে এক্সিওস জানায়, পরমাণু অস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় বিস্ফোরকের পরীক্ষাগার হিসেবে ইরান গোপন এই গবেষণাগারটিকে ব্যবহার করতো।


পাশাপাশি ইসরাইলি হামলায় বিধ্বস্ত তালেঘান-২ কমপ্লেক্স ভবনের স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিও রয়েছে বলে এক্সিওস’কে জানায় ইন্সটিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি।


মার্কিন ও ইসরাইলি কর্মকর্তাদের দাবি, ইরানি কর্তৃপক্ষ পরমাণু অস্ত্রের গবেষণা চালানোর জন্য তালেঘান-২ গবেষণাগারটিকে এইজন্যই বেছে নিয়েছিলো যেন কেউ এর উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ করতে না পারে। কারণ এই কমপ্লেক্সকে সহজেই বেসামরিক উদ্দেশ্যের জন্য ব্যবহৃত গবেষণাগার হিসেবে দেখানোর সুযোগ রয়েছে।


এ ব্যাপারে এক্সিওসকে এক মার্কিন কর্মকর্তা জানান, ‘ইরানি বিজ্ঞানীরা সেখানে পরমাণু অস্ত্রের উৎপাদন প্রক্রিয়া যেন শুরু করা যায় সে ব্যাপারে গবেষণা চালাচ্ছিলেন। গবেষণাগারটির বিষয়ে অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। ইরানের সরকারের খুব ক্ষুদ্র একটি অংশই এর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতো। বেশিরভাগ কর্মকর্তাই এর অবস্থান সম্পর্কে জানতো না।’

 

আরও পড়ুন: উত্তেজনার মধ্যে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রদর্শন করলো ইরান


চলতি বছরের প্রথম দিকে প্রথম পারচিনে অবস্থিত এই গবেষণাগারটির তথ্য সম্পর্কে মার্কিন ও ইসরাইলি গোয়েন্দারা প্রথম জানতে পারে বলে জানায় এক্সিওস। ইরানি বিজ্ঞানীরা সেখানে পরমাণু অস্ত্রে ব্যবহারের জন্য কম্পিউটার মডেলিং ও বিস্ফোরক নিয়ে গবেষণা করছিলেন।


এক্সিওস আরও দাবি করে, গত জুন মাসেও মার্কিন কর্মকর্তারা ইরানকে এই গবেষণাগারে হওয়া সন্দেহজনক গবেষণার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তবে তাদের ধারণা ছিলো, ইরান এই সতর্কবার্তাকে আমলে নিয়ে সেখানে কার্যক্রম বন্ধ করে দেবে। কিন্তু ইরান তা না করে গবেষণা চালিয়ে যায়।


ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলার ব্যাপারে সায় ছিলো না যুক্তরাষ্ট্রের


ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পাল্টা জবাবে ইসরাইল এই তালেঘান-২ গবেষণাগারকে নিজেদের হামলার লক্ষ্যস্থল হিসেবে নির্ধারণ করলেও অবশ্য এ ব্যাপারে সায় ছিলো না মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের।


এ ব্যাপারে এক্সিওস জানায়, ইসরাইলের অভ্যন্তরে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে ইরানের পরমাণু স্থাপণায় ইসরাইল যেন পাল্টা হামলা না চালায় সে জন্য ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ইরানের পরমাণু স্থাপনায় ইসরাইলি হামলায় মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই জো বাইডেন ইসরাইলকে এই হামলা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান বলে নিজেদের প্রতিবেদনে জানায় এক্সিওস।


যে কারণে তালেঘান-২ কমপ্লেক্সকেই টার্গেট করলো ইসরাইল


যেহেতু তালেঘান-২ গবেষণাগারটি ইরানের স্বীকৃত পরমাণু গবেষণাগার নয়, সেহেতু সেখানে হামলা হলেও ইরান তা ফাঁস করতে বা স্বীকার করতে চাইবে না বলেই ধরে নেয় ইসরাইল। কারণ সেখানে পরমাণু স্থাপনা থাকার বিষয়টি ইরান স্বীকার করে নিলে তা হবে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ইরানের সঙ্গে হওয়া পশ্চিমাদের পরমাণু চুক্তির লঙ্ঘন। এ পরিস্থিতিই মূলত ইসরাইলকে ইরানে হামলার টার্গেট হিসেবে এই তালেঘান-২ গবেষণাগারকেই বেছে নেয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করে বলে মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায় এক্সিওস।


পাশাপাশি তালেঘান-২ গবেষণাগারে হামলা চালিয়ে ইসরাইল ইরানকে এই বার্তা দিতে চেয়েছে যে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির প্রতিটি পদক্ষেপ সম্পর্কে তারা অবহিত এবং এমনকি গোপন গবেষণা কার‌্যক্রমও তাদের নজরদারির বাইরে নয়।


এদিকে ইসরাইলি কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে এক্সিওস আরও জানায়, ইরানে ইসরাইলের পাল্টা হামলায় শুধু তেহরানের পরমাণু অস্ত্র বানানোর সামর্থ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, একই সঙ্গে এই হামলায় ধ্বংস হয়েছে দেশটির দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বানানোর গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জামও। এর মাধ্যমে ইরানের নতুন করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণের সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি এর ফলে ইসরাইলে ভবিষ্যতে ইরানের নতুন কোন ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আশঙ্কাও হ্রাস পেয়েছে বলে দাবি করেন ইসরাইলি কর্মকর্তারা।


এই পরিস্থিতির মধ্যেই সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন ইরানকে ইসরাইলে নতুন করে যে কোন হামলার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে বলে মার্কিন ও ইসরাইলি কর্মকর্তাদের বরাতে দাবি করেছে এক্সিওস। জানা গেছে, ইরান যদি ইসরাইলে ফের হামলা চালায় সেক্ষেত্রে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালানোর ব্যাপারে ইসরাইলকে আর বিরত রাখা যাবে না বলে তেহরানকে জানিয়ে দেয় হোয়াইট হাউজ।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন