মেধাবী শিক্ষার্থী শ্বাশত সৌম্য (২৮)। ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার প্রতি ছিল তার মনোযোগ। পড়ালেখা ছাড়া কিছুই ভাবতে পারতেন না তিনি। অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) স্কলারশিপের সুযোগ পেয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করতে চলে যান সেখানে।
পিএইচডিও শেষ পর্যায়ে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে গবেষণা করে সফলও হয়েছিলেন তিনি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাড়া পড়ে যায় তার এ গবেষণা।
আর এ গবেষণায় সফল হওয়ার পরেই তাকে চলে যেতে হলো না ফেরার দেশে। কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার একটি লেক থেকে তার নিথর দেহ উদ্ধার করা হয়। সম্প্রতি তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডায় গিয়েছিলেন দি ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া কানাডা’র এনএলপি গ্রুপের আমন্ত্রণে একটি বক্তৃতা দিতে। মাত্র ২৮ বছর বয়সেই তার জীবন প্রদীপ নিভে গেল।
সৌম্যের পারিবারিক সূত্র জানায়, কুষ্টিয়া জেলা সদরের আলামপুর গ্রামের সুশান্ত প্রামাণিক ও প্রফেসর শিখা চক্রবর্তীর বড় ছেলে শাশ্বত সৌম্য (২৮)। সৌম্য ২০১৩ সালে ঢাকা আইডিয়াল স্কুল থেকে এসএসসি, ২০১৫ সালে ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ২০২১ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে কম্পিউটার সায়েন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে জিপিএ- ৪.০০ (৪ এর মধ্যে ৪) পেয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবনের শুরুতে তিনি ২০২১ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর স্থায়ীভাবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ২০২২ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) স্কলারশিপের সুযোগ পেয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করতে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে।
আরও পড়ুন: নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় পুলিশ কর্মকর্তা নিহত
তিনি সেখানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের শেষ পর্যায়ে ছিলেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। গবেষণায় তিনি সফলও হন। সম্প্রতি শাশ্বত সৌম্য সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিভিন্ন প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ে তার গবেষণার বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সারা বিশ্বে তার গবেষণা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
গত ২৯ মে কানাডার দি ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার এনএলপি গ্রুপের আমন্ত্রণে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডায় গিয়ে তার গবেষণার বিষয়টি উপস্থাপন করেন। গবেষণার বিষয়টি উপস্থাপনের সময় মুগ্ধ হয় কানাডার গবেষক দল। একারণে পরদিন ৩০ মে সৌম্যকে তারা কানাডিয়ান সরকারের সঙ্গে কিছু কাজ করার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য প্রস্তাব দেন এবং তাকে কানাডায় দুই সপ্তাহ থাকার অনুরোধ করেন। ওই প্রস্তাব ভেবে দেখতে তাদের কাছে এক রাত সময় চান সৌম্য। পরদিন চিন্তা ভাবনা করে কানাডার এনএলপি গ্রুপের প্রস্তাবে সম্মতি দেন সৌম্য এবং হোটেলে থেকে যান।
এরপর ৩১ মে শাশ্বত সৌম্য তার ফেসবুকে ‘দি গ্রেট আমেরিকান ড্রিম ইজ ডেড’ শিরোনাম দিয়ে একটি লেখা পোস্ট দেন।
ওই পোস্টে তিনি লিখেন, ‘গত সপ্তাহে আমি ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি টক দিতে এসেছিলাম। এরপর আমার অন্যান্য আমন্ত্রিত বক্তৃতা ছিল বার্কলি, প্রিন্সস্টন ও হার্বাডের মতো নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি দারুণ উচ্ছ্বসিত ছিলাম, কারণ আমি জানি আমি যা করি তাতে আমি ভালো।’
পোস্টে তিনি আরও লেখেন, ‘ইউবিসি-তে বক্তৃতার পর এখানকার এনএলপি গবেষক দল আমাকে কিছুদিনের জন্য কাজ করার প্রস্তাব দেয়। এক রাত চিন্তা করে আমি রাজি হয়ে যাই। কিন্তু আমার অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। আমার আমেরিকান স্বপ্ন মৃত এবং তা মৃতই থাকবে। যে দেশটা এক সময় দক্ষ অভিবাসীদের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল, এখন তারা সেসব অভিবাসীদের নিরুৎসাহিত করছে। মানুষ, সঠিক সিদ্ধান্ত নাও। পৃথিবী বদলে যাচ্ছে, আর যুক্তরাষ্ট্র তাদের আকর্ষণ হারাচ্ছে, বিশেষ করে তাদের কাছে যারা শুধু গবেষণা আর কাজ দিয়ে দুনিয়াকে বদলাতে চায়।’
ফেসবুকে এমন স্ট্যাটাস দেয়ার একদিন পর ২ জুন কানাডার স্থানীয় সময় সকালে দি ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার কেলৌনা ক্যাম্পাসের পাশের ওকানাগান লেক থেকে সৌম্যর মৃতদেহ ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তার হঠাৎ চলে যাওয়া শুধু বুয়েট বা তার সহপাঠীদের জন্য নয়, গোটা দেশ ও আন্তর্জাতিক গবেষণা অঙ্গনের জন্যই এক অপূরণীয় ক্ষতি।
এদিকে সৌম্য’র এমন মৃত্যু পরিবার, স্বজন, সহপাঠী, শিক্ষক ও শুভাকাঙ্ক্ষি কেউ মেনে নিতে পারছেন না। সৌম্য’র মৃত্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা প্রশ্ন তুলে পোস্ট করছেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। কেউ বলছেন ‘পানিতে ডুবে’, আবার কেউ লিখছেন ‘মৃত্যু স্বাভাবিক নয়’, আবার কেউ লিখছেন ‘মেনে নিতে পারছেন না এমন মৃত্যু’।
আরও পড়ুন:ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় মেটাডোর কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি নিহত
পরিবারের সদস্যরা জানায়, গত ১ জুন রাত ১১ টার পর থেকে মা-বাবার সঙ্গে শাশ্বত সৌম্য’র যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে কানাডার পুলিশ জানিয়েছে, সৌম্য’র শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি, তবে তদন্ত চলমান রয়েছে।
সৌম্য’র পরিবারের সদস্যরা এমন মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান। তারা বলেন, ‘শাশ্বত সৌম্য’র অকালে চলে যাওয়া শুধু পরিবারের বা দেশের নয়, এটা বিশ্বের এবং মানবকল্যাণের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। বিজ্ঞানী সৌম্য মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে গেছে সত্য, কিন্তু এমন মেধা শত বছরেও তৈরি হবে কিনা সেটা অনিশ্চিত।’
পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, সৌম্য ভোরের অন্ধকারে লেকের দিকে হাঁটতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যেতে পারেন। এমআইটি তার মৃত্যুকে ‘অপ্রত্যাশিত ও মর্মান্তিক’ বলে উল্লেখ করেছে।
আগামী ২০ জুন (শুক্রবার) সৌম্যের মরদেহ বাংলাদেশে পৌঁছানোর কথা রয়েছে বলে জানিয়েছে কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষ।