আধুনিক বিজ্ঞান ও শিল্পকলায় মুসলিমদের ১০ অবদান

১ সপ্তাহে আগে
আপনি কি কখনো ভেবেছেন সংখ্যার ‘শূন্য’ কোথা থেকে এসেছে? অথবা ‘বীজগণিত’ যে বিষয়টি একই সাথে কঠিন আবার আকর্ষণীয়, তা কে শুরু করেছিলেন? এর উত্তর পাওয়া যায় ইসলামি সভ্যতার ইতিহাসে, বিশেষ করে ইসলামের স্বর্ণযুগে মুসলিম উদ্ভাবকদের মেধার ভাণ্ডারে।

অষ্টম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে ইসলামী বিশ্ব ছিল জ্ঞান ও উদ্ভাবনের কেন্দ্রবিন্দু। এ সময়ের মুসলিম পণ্ডিতরা নানা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবন করেছিলেন। তাদের অবদান আধুনিক বিজ্ঞান, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র এবং শিল্পকলার ভিত্তি গড়ে তোলে, যার প্রভাব আজও আমাদের পৃথিবীতে দৃশ্যমান।

 

আপনি কি জানেন, কোরআনে ইলম বা জ্ঞানের কথা ৭৭৯ বার এসেছে? এটি প্রমাণ করে ইসলামে জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব কতখানি। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 

 

আল্লাহ, তার ফেরেশতা এবং সমগ্র সৃষ্টিজগৎ সেই ব্যক্তির জন্য দোয়া করে, যে উপকারী জ্ঞান প্রচার করে।

 

ইসলামের স্বর্ণযুগের পরিচয়

ইসলামের স্বর্ণযুগ ছিল বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির অসামান্য বিকাশের সময়। মুসলিম পণ্ডিতরা অসংখ্য আবিষ্কার ও গবেষণা করেছিলেন, যেগুলোর প্রভাব এখনো টিকে আছে।

 

আরও পড়ুন: ইহুদিদের লাল গরু: কী আছে ধর্মগ্রন্থে?

 

সময়কাল ও ভৌগোলিক বিস্তৃতি

 

এই যুগ মূলত অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। স্পেন থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত এক বিশাল ভৌগোলিক অঞ্চলে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। বাগদাদ, কায়রো ও কর্ডোবা হয়ে ওঠে শিক্ষার মহান কেন্দ্র।

 

৮২৫ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল-মামুনের উদ্যোগে শুরু হওয়া এই প্রতিষ্ঠান জ্ঞানের বাতিঘরে পরিণত হয়। এখানে বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির পণ্ডিতরা একত্র হয়ে অনুবাদ, গবেষণা ও উদ্ভাবনে ব্যস্ত থাকতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জ্ঞান অনুসন্ধান করো দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত। তখনকার যুগে জ্ঞানীরা আজকের খেলোয়াড়দের মতোই সম্মান ও পারিশ্রমিক পেতেন। এই পরিবেশই আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত রচনা করে।

 

আধুনিক গণিতের ভিত্তি। সপ্তম থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত আরবি গণিত ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করে। বীজগণিতের সূচনা হয়। ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নেওয়া মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খোয়ারিজমি বীজগণিতের জনক হিসেবে পরিচিত। Al-Jabr থেকেই Algebra শব্দের উৎপত্তি। তিনি প্রথম পদ্ধতিগতভাবে রৈখিক ও দ্বিঘাত সমীকরণ সমাধানের নিয়ম তৈরি করেন।

 

ত্রিকোণমিতি ও উন্নত হিসাব

 

আবু ওয়াফা ও আল-বাত্তানি ত্রিকোণমিতিতে যুগান্তকারী অবদান রাখেন। কটানজেন্টের ধারণা, সাইন টেবিল—এসব তাঁরাই প্রথম আনেন। আর ১৪২৪ সালে আল-কাশানি পাই এর মান ষোলো ঘর পর্যন্ত নির্ণয় করেন।

 

জ্যোতির্বিদ্যা

 

মুসলিম জ্যোতির্বিদরা অষ্টম শতকেই অ্যাস্ট্রোল্যাব উন্নত করেন। এটি ছিল নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ ও সময় নির্ধারণের মূল যন্ত্র। আল-বাত্তানি সৌর বছরের সঠিক হিসাব দেন, আর নাসির উদ্দিন আল-তুসি জটিল গ্রহ-গতির মডেল তৈরি করেন। তাদের কাজ ইউরোপীয় জ্যোতির্বিদদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।

 

আরও পড়ুন: যে নফল নামাজ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়

 

চিকিৎসাবিজ্ঞান

 

আল-জাহরাবি (Abulcasis) আধুনিক সার্জারির জনক। তিনি শল্যচিকিৎসার উপর বিশ্বকোষ লিখেছিলেন এবং বহু যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন, যেগুলোর ব্যবহার আজও চলে।

 

ফার্মাকোলজি

 

মুসলিম রসায়নবিদরা পটাশ, অ্যালকোহল ইত্যাদি আবিষ্কার করেন, যা ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগে। হাসপাতাল ব্যবস্থা। ৭০৬ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে প্রথম আধুনিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ইসলামী দুনিয়ার বড় শহরগুলোতে চিকিৎসা শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য বিশেষ হাসপাতাল গড়ে ওঠে।

 

ইবনে সিনার“আল-কানুন ফি-ত্বিব্ব ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭০০ বছর পাঠ্য ছিল।

 

মুসলিমদের ১০টি বিশেষ অবদান

১. অপটিক্স ও ক্যামেরা অবস্কিউরা (ইবনে হাইথাম)
২. প্রাথমিক উড্ডয়ন যন্ত্রের ধারণা (আব্বাস ইবনে ফিরনাস)
৩. উন্নত অ্যাস্ট্রোল্যাব
৪. গম্বুজ ও খিলানের স্থাপত্য কৌশল
৫. আল-খোয়ারিজমির অ্যালজেব্রা
৬. আল-জাহরাবির শল্যযন্ত্র
৭. হাসপাতাল ব্যবস্থা
৮. মানচিত্রবিদ্যা (আল-ইদ্রিসি)
৯. ইসলামী ক্যালিগ্রাফি ও শিল্পকলা
১০. সংগীত ও সাহিত্য (রুমি, ওমর খৈয়াম, আলিফ লায়লা)

 

শিল্প ও স্থাপত্য

ইসলামী শিল্পকলা তার জ্যামিতিক নকশা, ক্যালিগ্রাফি ও আরাবেস্কের জন্য বিখ্যাত। স্থাপত্যে গম্বুজ, খিলান, মুকারনাস ছিল অনন্য। আলহাম্ব্রা (স্পেন), তাজমহল (ভারত), ডোম অব দ্য রক (জেরুজালেম) এর সেরা নিদর্শন।

 

প্রাচীন জ্ঞান সংরক্ষণ

 

বাইতুল হিকমা-তে গ্রীক, ভারতীয় ও পারস্যের বহু গ্রন্থ আরবিতে অনূদিত হয়। পরে এগুলো ইউরোপে পৌঁছে রেনেসাঁর সূচনা করে। সংগীত ও সাহিত্য। মুসলিমরা ইউরোপে লুট, রেবাবের মতো বাদ্যযন্ত্র নিয়ে যান। “One Thousand and One Nights” বিশ্বসাহিত্যে অমর। রুমি ও ওমর খৈয়ামের কবিতা আজও সারা দুনিয়ায় পড়া হয়।

 

সপ্তম থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত মুসলিম বিজ্ঞানী ও শিল্পীরা এমন অবদান রেখেছেন, যা ইউরোপকে অন্ধকার যুগ থেকে রেনেসাঁয় উত্তরণে সাহায্য করেছে। তাদের উদ্ভাবন আজও আধুনিক বিশ্বে আলো ছড়াচ্ছে। ২০০৮ সাল থেকে 1001 Inventions প্রদর্শনী বিশ্বজুড়ে মুসলিম অবদানকে তুলে ধরছে। এ ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় জিজ্ঞাসা, সহযোগিতা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ই মানব অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন