অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর কেমন আছে বাংলাদেশ, এ নিয়ে কী ভাবছেন দেশের নাগরিকরা, এ বিষয়ে অক্টোবরের ১৩ থেকে ২৭ তারিখ, ভয়েস অফ আমেরিকা দেশব্যাপী একটি জরিপ করে।
এ জরিপটির ফলাফল সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।
জরিপের ফলাফল নিয়ে অংশীজনদের মন্তব্য ও বিশ্লেষণ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে ভয়েস অফ আমেরিকা বাংলা।
আরিফ জেবতিক
অ্যাক্টিভিস্ট , সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার
প্রশ্নঃ ভয়েস অফ আমেরিকা বাংলার একটি জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে ৬১ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ ১ বছরের মধ্যে নির্বাচন চান আবার ওই একই জরিপের অন্য একটি প্রশ্নের উত্তরে ৬৫ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন তারা চান, অন্তর্বর্তী সরকার যা যা সংস্কার করা দরকার বলে মনে করবে সেই সবগুলো সংস্কার শেষেই নির্বাচন হোক। এ বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?
আরিফ জেবতিকঃ মানুষের মাঝে সংস্কার নিয়ে প্রত্যাশা আছে। সবাই এমন একটি দেশ গড়তে চান, যেখানে মানবিক মর্যাদা, সাম্য আর সামাজিক ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে। মানুষ নাগরিক হিসেবে তার নূন্যতম অধিকারটুকু বুঝে পাবে, সে একটি সুস্থ সমাজে স্বাভাবিক নাগরিক সম্মান নিয়ে জীবন ধারন করতে পারবে। একই সাথে রাষ্ট্র দুর্নীতিমুক্ত ও কার্যকর হবে।
কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম যতই দিন যাচ্ছে, ততই মানুষকে হতাশ করছে। আর্থিক বিশৃংখলা থেকে বেরিয়ে আসার কোন সুস্পষ্ট রূপরেখা এখনও দেখা যাচ্ছে না, উপরন্তু সরকার টাকা ছাপিয়ে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ানোর সেই চিরাচরিত পথেই হাটছে। দুর্নীতি আর ব্যাংক লুটের মাধ্যমে পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারের কোন প্রচেষ্টা চোখে পড়ছে না। পূঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। দ্রব্যমূল্য অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। আইনশৃংখলার অবস্থাও খুবই শোচনীয়। আশেপাশে মব সন্ত্রাস একটি স্বাভাবিক অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে, কলেজ টু কলেজ দলবেঁধে আক্রমন চলছে, শিল্পকারখানা লুট হচ্ছে- কিন্তু এসবকে নিয়ন্ত্রনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। সাধারন মানুষের একটি বড় অংশই মনে করেন যে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার গুড গভর্নেন্সের মাধ্যমে এসবে ভুমিকা রাখতে পারবে, তাই মানুষ নির্বাচন চাচ্ছে।
কিন্তু রাজনৈতিক দলের সরকার দেশের মৌলিক ও জরুরি সংস্কারগুলো করতে উৎসাহিত হবে, এমনটাও পূর্ব অভিজ্ঞতার কারনে মানুষ বিশ্বাস করতে পারছে না। এই দুইটি চাহিদাকে সামনে রেখেই মানুষ মনে করে যে মৌলিক সংস্কারগুলো শেষ করে নির্বাচনে যাওয়া উচিত, কিন্তু সেটার জন্য অনির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করাটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। সংস্কার শেষ করে এক বছরের মধ্যে নির্বাচনে যাওয়ার এই জনপ্রত্যাশা তাই যৌক্তিক এবং স্বাভাবিক।
প্রশ্নঃ বাংলাদেশের ৫৭ শতাংশ মানুষ রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে আর ৩৫. ৫ শতাংশ চান আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হোক। সম্প্রতি ভয়েস অফ আমেরিকা বাংলা'র এক জরিপে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত একটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ না করার পক্ষে অধিকাংশ মানুষ মত দিয়েছেন, এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন?
আরিফ জেবতিকঃ মানুষের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। মানুষ যদি তার পছন্দের দলকে ভোট দেয়ার অধিকার পায় তাহলে তারাই বিচার করতে পারবে যে বিগত সময়ের ভুমিকার জন্য কোন দলকে কতটুকু প্রত্যাখ্যান করবে। আওয়ামী লীগের সকল সাফল্য ও ব্যর্থতার বিচার তাই ভোটের মাধ্যমেই হওয়া দরকার, সেটিই জরিপে ফুটে উঠেছে।
বাংলাদেশের সাধারন মানুষ রাজনৈতিক উগ্রতা এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের সাধারন মানুষ সবসময় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। আওয়ামী লীগ এবার যে রক্তাক্ত নজির রেখে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে সেরকম মাত্রায় আগে কখনো ঘটে না থাকলেও, বাংলাদেশে আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। খুব কম সময়ই এখানে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনা ঘটেছে। তাই গণআন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হলেই যদি কোন দলকে নিষিদ্ধ করতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের বড় দলগুলো (সবাই) কমবেশি এই প্রক্রিয়ার শিকার হবে। এতে করে রাজনৈতিক অস্থিরতা কখনোই কমবে না। সাধারন মানুষ তাই এরকম চরমপন্থাকে পছন্দ করছেন না। যদি এখন তাড়াহুড়ো করে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে জটিলতা বাড়বে, রাজনৈতিক অশান্তি বাড়বে। দেশের একটি বড় দলকে বাইরে রেখে নির্বাচন করলে সেটি অংশগ্রহনমূলক নির্বাচন হবে না, বরং নির্বাচনটি বিতর্কিত হবে।
এত রক্তস্নানের পরে একটি অবিতর্কিত, আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহনযোগ্য নির্বাচনই জনগনের আকাঙ্ক্ষা। আওয়ামী লীগকে সেই নির্বাচনে গ্রহন বর্জনের সম্পূর্ণ অধিকার দেশের জনগনের হাতেই থাকা উচিত, একটি অনির্বাচিত সরকার কলমের খোঁচায় সেটি বন্ধ করে দিলে দেশের জন্য ভালো হবে না। তাই সাধারন মানুষ কারো উস্কানিতে পা দিতে রাজি নন, তারা অবাধ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোকে মূল্যায়নের পক্ষে।
প্রশ্নঃ আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতাদের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করার পক্ষে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৪৬.৮ শতাংশ। এদের মধ্যে ৫৪.৫ শতাংশ চান আওয়ামী লীগের এই নেতাদের আজীবনের জন্য রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হোক। দল হিসেবে অধিকাংশ মানুষ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করার পক্ষে হলেও আওয়ামী লীগ নেতাদের রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা দেখতে চায় ৪৬.৮ শতাংশ মানুষ যাদের অর্ধেকের বেশি আওয়ামী লীগ নেতাদের আজীবন নিষিদ্ধের পক্ষে। এই ফলাফলটা কিভাবে দেখছেন?
আরিফ জেবতিকঃ আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে যার সম্পর্ক অঙ্গা-অঙ্গীভাবে মিশে আছে। কিন্তু বর্তমান নেতারা সেই স্পিরিট ধারন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আর্থিক খাতে সীমাহীন দুর্নীতি হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে কখনোই একরম হয়নি যে মানুষ ব্যাংকে গিয়ে টাকা পাচ্ছে না। এটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা একটি দুটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে ঘটেছে এমন নয়। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা ব্যাংক মালিকরা প্রায় প্রকাশ্যে এই টাকা লুটপাট করেছে, যেটি তখনকার সরকারি দল আওয়ামী লীগের নজরের বাইরে থাকার কথা নয়। সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে, কিন্তু তারা নিরাপদে দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে পেরেছে।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই জানিয়েছেন যে তার পিওন ৪শ কোটি টাকার মালিক এবং সে হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না- এরকম দুর্নীতির খবর পাওয়ার পরেও সেই পিওনের কোন শাস্তি হতে দেখেনি মানুষ।
তারপর জুলাইয়ের একটি সাধারন চাকুরির কোটা সংক্রান্ত আন্দোলন দমনে যে পরিমান কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে সাধারন ছাত্র জনতার উপর অকাতরে গুলি করে শতশত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, এটি কোন সুস্থ স্বাভাবিক বিষয় না। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এই দায় এড়াতে পারবেন না। সুতরাং জনগনের একটি অংশ যদি মনে করে এই নেতাদেরকে আর রাজনীতি করতে দেয়া উচিত নয়, সেই প্রতিক্রিয়াকে আমি স্বাভাবিক ভাবেই দেখি।
যদিও ব্যক্তিগত ভাবে আমি কাউকে জোর করে রাজনীতি করার অধিকার কেড়ে নেয়ায় বিশ্বাস করি না। অপরাধের জন্য বিচার হবে এবং সেই বিচারে যাদের নৈতিক স্খলন প্রমানিত হবে তারা প্রচলিত আইনেই আর নির্বাচন করতে পারবে না। আর বাকি যারা নৈতিক স্খলনে অভিযুক্ত হবেন না কিন্তু এই অরাজক পরিস্থিতি তৈরির পেছনে তাদের সুপ্রিম রেসপনসিবিলিটি অস্বীকার করার উপায় নেই, (তারা) কেউ রাজনীতি করতে পারবেন কী না সেই সিদ্ধান্ত জনগন নিবে, সরকারের এখানে হস্তক্ষেপ করার কোন সুযোগ থাকা উচিত নয়।